|| মোহাম্মদ হুজাইফা ||
দেশে ইসলাম শেখার প্রধান ও প্রাচীনতম মাধ্যম হিসেবে কওমি মাদরাসা ধারাটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত একটি পূর্ণাঙ্গ সিলেবাস অনুযায়ী এখানে ইসলামি জ্ঞান চর্চা হয়। গবেষণাভিত্তিক এ ধারাটি বহু প্রজন্ম ধরে দীনি শিক্ষার শক্ত ভিত তৈরি করেছে।
তবে কর্মজীবী ও বয়স্ক ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের জন্য এই কওমি ধারায় শিক্ষা গ্রহণ প্রায় অসম্ভব। পেশাগত ব্যস্ততা, বয়সগত সীমাবদ্ধতা এবং সময়ের অভাবে তারা কওমি ধারায় পড়াশোনার সুযোগ পান না, যদিও অনেকেই ইসলামিক শিক্ষার প্রতি গভীর আগ্রহ পোষণ করেন।
এই প্রেক্ষাপটে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছে শিক্ষার এক নতুন দিগন্ত- ‘নৈশ মাদরাসা’ নামে বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই মাদরাসাগুলো স্বতন্ত্র সিলেবাস অনুযায়ী পরিচালিত হয়, যেখানে কর্মব্যস্ত মানুষ রাতের সময় ইসলামিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ পান।
নৈশ মাদরাসার পথচলা ও বিস্তৃতি
আন নূর ইসলামিয়া নৈশ মাদরাসার নাজিমে তালিমাত ও দাওয়া বিভাগের প্রধান মুফতি মুজিবুর রহমান কাসেমীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে সারাদেশে দুই শতাধিক নৈশ মাদরাসা রয়েছে। ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোতে এসব মাদরাসার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি।
তিনি জানান, ২০০৩ সালে মুফতি যুবায়ের আহমদ মাযাহেরি আবদুল হাই পাহাড়পুরী হুজুরের পরামর্শে ‘আন নূর ইসলামিয়া নৈশ মাদরাসা’ প্রতিষ্ঠা করেন। মুফতি মুজিবুর রহমান কাসেমীর ভাষায়, ‘এর আগে বাংলাদেশে বয়স্কদের জন্য কোনো পূর্ণাঙ্গ ইসলামি সিলেবাসভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল না।’
মুফতি কাসেমী আরও বলেন, ‘বর্তমানে সারাদেশে তিনটি নিয়মিত দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত নৈশ মাদরাসা রয়েছে। এছাড়া আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই পর্যায়ের শিক্ষা দিচ্ছে।’
সিলেবাস ও শিক্ষা বিভাগ
নৈশ মাদরাসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল বিভাগ হলো ফরজে আইন বিভাগ, যেখানে শিক্ষার্থীরা কুরআন তেলাওয়াত এবং ইসলামের মৌলিক মাসয়ালা সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করে। এরপর রয়েছে কিতাব বিভাগ, যার মেয়াদ সাত বছর।
কিতাব বিভাগে অনেকটা কওমি মাদরাসার নেসাব অনুযায়ী কুরআন-হাদিস-ফিকহ পড়ানো হয়।
এই মাদরাসাগুলোর ছাত্ররা কওমি মাদরাসাভিত্তিক বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ ও হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়া-এর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এবং প্রথম ও দ্বিতীয় বিভাগে পাস করার গৌরবও অর্জন করে বলে জানা গেছে, যা নৈশ মাদরাসার জন্য অত্যন্ত প্রশংসনীয়।
নৈশ মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড
নৈশ মাদরাসাগুলোর শিক্ষাব্যবস্থাকে সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানের জন্য ২০০৬ সালে গঠিত হয় ‘নৈশ মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড’। এ বোর্ডের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মাওলানা নাজমুদ্দিন। এই বোর্ডের অধীনে প্রতি বছর কেন্দ্রীয় পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ পরীক্ষায় প্রায় দেড় শত শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছেন।
এই বছর অনুষ্ঠিত ১২তম কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় মোট দুটি মারহালায় (স্তর) পরীক্ষা হয়। অংশগ্রহণকারী ১৪৬ জনের মধ্যে উত্তীর্ণ হন ১৪৪ জন। গড় পাসের হার ৯৮%।
নৈশ মাদরাসার প্রয়াস বিস্তৃত করার কথা উল্লেখ করে মুফতি মুজিবুর রহমান কাসেমী আওয়ার ইসলামকে বলেন, উত্তরবঙ্গ এবং পাহাড়ি এলাকাগুলোতে মিশনারি কার্যকলাপ বেশি চলে। সেখানে ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রবণতাও বেশি। তাই ওই এলাকাগুলোতে নৈশ মাদরাসাভিত্তিক বয়স্ক শিক্ষাকার্যক্রম বাড়ানো এখন সময়ের জোর দাবি।
নৈশ মাদরাসাগুলোতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ কেমন বা এখানে কোন ধরনের লোকেরা বেশি পড়তে আসে এমন প্রশ্নের জবাবে আন নুর ইসলামিয়া নৈশ মাদরাসার দাওয়া বিভাগের ছাত্র রায়হান মাহমুদ বলেন, নৈশ মাদরাসায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষই পড়তে আসে। তবে যারা তাবলিগের দীর্ঘ সময় লাগান তাদের মধ্যে দীন শেখার আগ্রহ বেশি দেখা যায়। সেই আগ্রহ থেকেই মূলত তারা নৈশ মাদরাসাগুলোতে বেশি পড়তে আসে।
এদিকে মুফতি মুজিবুর রহমান কাসেমী বলেছেন, বর্তমানে বয়স্ক বা মুরব্বিদের তুলনায় যুবকদের বেশি আসতে দেখা যাচ্ছে। যারা ভার্সিটিতে পড়াশোনা করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ইসলাম শেখার সুযোগ পায় না তারা নৈশ মাদরাসায় এসে শেখার চেষ্টা করে।
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, অনেকেই নৈশ মাদরাসা থেকে ফারেগ হয়ে বিভিন্ন কওমি মাদরাসার খেদমতে নিয়োজিত হচ্ছেন। তবে এই নৈশ মাদরাসাগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো, সাধারণ মানুষদের দিন শেখানোর মাধ্যমে দীন সম্পর্কে মূর্খতার অন্ধকার থেকে তুলে এনে আলোর পথে হাঁটার যোগ্যতা তৈরি করে দেওয়া।
মুফতি কাসেমী আলেম সমাজের উদ্দেশে বলেন, কওমি মাদরাসার মাধ্যমে মুসলিম শিশুরা ইসলাম শিক্ষা পূর্ণাঙ্গভাবে অর্জন করতে পারছে। তবে জেনারেল শিক্ষিত বয়স্ক কিংবা কর্মজীবী অনেক মানুষ, যারা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে শৈশবে ইসলাম শিক্ষা অর্জন করতে পারেনি তারা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞই থেকে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি মুসলিম সমাজের জন্য আশঙ্কার কারণ।
তিনি আরও বলেন, এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার জন্য নৈশ মাদরাসা কিংবা বয়স্ক শিক্ষা ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। তাই সাধারণ মুসলিম সমাজকে ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলার জন্য আলেমদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি প্রয়োজন।
বাংলাদেশ 'নৈশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড’ থেকে প্রকাশিত 'দ্বীনি শিক্ষা ও চেতনা: প্রাসঙ্গিক ভাবনা' বইয়ের ৪২ পৃষ্ঠায় নৈশ মাদরাসা প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব তুলে ধরে বলা হয়েছে-
“নিজের ঈমান আমাল সংরক্ষণ করার জন্য উলামাদের সংশ্রব গ্রহণ ও তাদের থেকে দীন শিক্ষার বিকল্প নেই। আখেরাতে মুক্তির জন্য দীন ছাড়া উপায় নেই। বর্তমানে মাদরাসার তালিবে ইলমদের সংখ্যা একেবারেই সামান্য। এর বাহিরে বিশালসংখ্যক মানুষ কর্মজীবী, ব্যবসায়ী, স্কুল কলেজ, ভার্সিটির শিক্ষার্থী। সকল কর্মব্যস্ত মানুষের বিশুদ্ধভাবে আসমানি মহাগ্রন্থ আল কুরআন পড়তে পারা, কুরআন-হাদিসের কষ্টিপাথরে যাচাই করে আকিদা-বিশ্বাস বিশুদ্ধ করা ও দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় মাসয়ালা-মাসায়েল জেনে আমল করার ব্যবস্থা নেই। এর জন্য আমাদের সমাজে বয়স্কদের ব্যাপকভাবে দীনি শিক্ষার ব্যবস্থা খুবই প্রয়োজন। আর যেহেতু সকলে দিনের বেলায় ব্যস্ত থাকেন, তাই নৈশকালীন মাদরাসা প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। আর এরই ধারায় বাংলাদেশে বহু নৈশ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হতে চলছে। এর দ্বারা নৈশ ছাত্রদের মাঝে দীনি চেতনাবোধ, আমালের জন্য ইলমের সীমাহীন গুরুত্ব অনুধাবনের যোগ্যতা তৈরি হচ্ছে। ইলমের সাথে আমালের ছাহাবা জমানার নমুনা ফুটে উঠছে। সাহাবায়ে কেরামদের জমানায় আলী রা. সহ কিছুসংখ্যক সাহাবা ব্যতীত প্রায় সকল সাহাবাই সারাদিনের কর্মব্যস্ততার মাঝেই ঈমান, ইলম ও আমলের দীনি সৌধ সমুন্নত করেছেন ও টিকিয়ে রেখেছেন। এ ক্ষেত্রে প্রণীধানযোগ্য হলো, হযরত সালমান ফারসী রা. এর কথা। তিনি প্রায় তিনশত থেকে চারশত বছর জীবন পেয়েছেন। শেষ সময়ে তিনি নবীজীর নিকটই পরিপূর্ণ ইলম অর্জন করেছেন। ইমাম আবু হানিফা বিশ বছর বয়সে ইলমে দীন শিক্ষা আরম্ভ করেন। ইমাম আবু ইউসুফ রহ. দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন। কিন্তু জ্ঞানের জন্য প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে বড় হয়েছিলেন। তার মা ও বাবা একাডেমিক ইচ্ছাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তারপরও তিনি বয়সকালে ইমাম আবু হানিফা রহ. এর দরসে দীর্ঘ ১৭ বছর ইলম অর্জন করে জামানার বড় ফকিহ, মুজতাহিদ ও মুহাদ্দিস হয়েছিলেন। এই আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, সত্যিকার ইলম পিপাসু যেকোনো বয়সেই যেকোনো কর্মব্যস্ততায় সঠিক ইলম অর্জন করে উভয় জাহানে নিজেকে ধন্য করা যায়।”
এমএইচ/