সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩২ ।। ২৩ শাওয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে ক্ষোভ, প্রতিবাদ জানালেন শায়খ আহমাদুল্লাহ বিবাহ একটি ইবাদত, এর পবিত্রতা রক্ষা করা জরুরি নারী অধিকার কমিশনের সুপারিশে আলেম প্রজন্ম-২৪-এর আপত্তি  জুলাই-আগস্টের ত্যাগের পরও কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ পাইনি: মির্জা ফখরুল নারীবিষয়ক সুপারিশগুলো কোরআন-হাদিসের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন: জামায়াত আমির ‘১৬ বছরের জঞ্জাল দূর না করে নির্বাচন দিলে সমস্যা সমাধান হবে না’  প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা সরকারি নিবন্ধন পেল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘কলরব’ ‘সিরাহ মিউজিয়াম’ চালু করছেন মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী মহাসমাবেশ সফল করতে যেসব কর্মসূচি নিয়েছে হেফাজত

ভারত স্বাধীনে আলেমদের ঐতিহাসিক ভূমিকা!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মূল: মাওলানা শওকত আলি কাসেমি, সিনিয়র অধ্যাপক দারুল উলুম দেওবন্দ।
অনুবাদ: ইবনে নাজ্জার।

ভারতবর্ষের মাদ্রাসাগুলো শুধুমাত্র অজ্ঞতা ও নিরক্ষরতা দূরীকরণ, বিভিন্ন ধরনের জ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রচার-প্রসার এবং মুসলিম জাতির ধর্মীয় ও জাতিগত দিক-নির্দেশনা প্রদানের গুরুদায়িত্ব পালন করেনি; বরং দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এদের অবদান সূর্যের ন্যায় স্পষ্ট। বিশেষ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, দাসত্ব ও পরাধীনতার অত্যাচার থেকে মুক্ত করা এবং দেশের জনগণের সাথে মিলে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনতে মাদ্রাসা ও উলামায়ে কেরামের আত্মত্যাগ স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার দাবিদার। তারাই তো ছিলেন অকুতোভয় আলেম, যারা এমন সময়ে স্বাধীনতার শিঙা ফুঁকিয়েছিলেন যখন দেশের অন্যান্য মানুষ অলসতার স্বপ্নে বিভোর ছিল, স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল আর দাসত্ববোধের অনুভূতি-উপলব্ধি হারিয়ে ফেলেছিল।

কবি বলেন, কুমিরের বসবাসকারী নদী থেকেই সেই উত্তাল তরঙ্গমালা সৃষ্টি হয় যা, কুমিরের বাসাকে তছনছ করে দেয়।

কিন্তু এটাও একটা বড় জাতীয় ট্র্যাজেডি যে, ১৫ আগস্টের ঐতিহাসিক ও স্মরণীয় জাতীয় দিবসের শুভক্ষণে যখন মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ স্মরণ করা হয় এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়, তখন এই স্বাধীনতাকামি আলেম মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়—যারা দেশের স্বাধীনতার স্বার্থে জেল-জরিমানার কষ্ট সহ্য করে, মাল্টার জেলে আর কালা পানির দ্বীপে সব ধরনের অত্যাচার সহ্য করে আত্মত্যাগ, জীবন দান ও ত্যাগস্বীকারের এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যা মানব জাতির ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না এবং দেশের প্রতিটি অঞ্চল তাদের আত্মত্যাগের অমর সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

কবি বলেন, এই বাগানের প্রত্যেকটি গাছ-পাতা, তরুলতা সবাই আমাদের অবস্থা জানে। তবে কেউ না জানলে, না জানুক। এমনকি ফুলও না জানুক। পুরো বাগানের মাটি তো আমাদের অবস্থা জানে।

ফলে, বর্তমান ভারতীয় জনগণের একটি বিশাল অংশ এই ভ্রান্তিতে ভুগছে যে, ধর্মীয় ও ইসলামি মাদ্রাসাগুলো সমাজ ও জাতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। দেশ ও জাতীয় স্বার্থের প্রতি উদাসীন হয়ে শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষা প্রচারে নিয়োজিত। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা আশে পাশের বিভিন্ন বিষয়ে বেখবর থাকে ফলে তাদের বুকের ভিতর দেশ ও জাতির সেবা করার অনুভূতির অপমৃত্যু ঘটে।

কিন্তু মাদ্রাসার গৌরবময় অতীত তাদের এই ভিত্তিহীন ধারণাকে একেবারেই ভুল, ভ্রান্তি ও প্রলাপ বলে ঘোষণা করেছে। আর মাদ্রাসা ও উলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে ভারতীয় ইতিহাসের কপালে এঁকে দেওয়া দেশ ও জাতির সেবায় অতুলনীয় অবদানের ছাপ ডেকে বলছে যে, মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সর্বদাই দেশের স্বার্থ রক্ষা করেছে, নিজেদের রক্ত-ঘাম দিয়ে ভারতের এই প্রিয় ভূমিকে সিঞ্চন করেছে।

তাই তো ভারত-স্বাধীনতার ইতিহাস তাদের আত্মত্যাগে কানায় কানায় ভরা। এমন হাজার হাজার আলেম মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন, যারা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন—সব ধরনের ত্যাগ স্বীকার করেছেন—নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছেন।

বিশেষ করে হজরত মাওলানা শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি, মাওলানা শাহ আবদুল আজিজ দেহলবি, মাওলানা শাহ রফিউদ্দিন দেহলবি, মাওলানা শাহ আবদুল কাদির দেহলবি, মাওলানা সাইয়িদ আহমদ শহিদ রায় বেরেলবি, মাওলানা সাইয়িদ ইসমাইল শহিদ দেহলবি, মাওলানা শাহ ইসহাক দেহলবি, মাওলানা আবদুল হাই বুধানবি, মাওলানা বেলায়েত আলি আজিমাবাদি, মাওলানা জাফর থানেস্বরি, মাওলানা আবদুল্লাহ সাদিকপুরি, মাওলানা নজির হুসাইন দেহলবি, মুফতি সদরুদ্দীন আঝুরদাহ, মুফতি ইনায়েত আহমেদ কাকুরি, মাওলানা ফরিদুদ্দিন শহিদ দেহলবি, সাইয়িদুদ তায়েফা হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি, স্বাধীনতার অগ্রনায়ক মাওলানা মুহাম্মদ কাসিম নানুতবি, মাওলানা রশীদ আহমদ গঙ্গুহি, কাজি ইনায়েত আহমদ থানবি, কাজি আব্দুল রহিম থানবি, হাফিজ জামান শহিদ, মাওলানা রহমতুল্লাহ কিরানবি, মাওলানা ফয়েজ আহমদ বদাউনি, মাওলানা আহমদুল্লাহ মাদ্রাজি, মাওলানা ফজলে হক খায়রাবাদি, মাওলানা রজিউল্লাহ বদাউনি, ইমামুল হিন্দ মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, স্বাধীনতা-বিপ্লবের অগ্রদূত শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দি, মাওলানা শাহ আবদুল রহিম রায়পুরি, মাওলানা মুহাম্মদ আলি জাওহর, মাওলানা হাসরাত মোহানি, মাওলানা শওকত আলি রামপুরি, মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি, মাওলানা ডক্টর বরকতুল্লাহ ভোপালি, শায়খুল ইসলাম মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি, মাওলানা কেফায়াতুল্লাহ দেহলবি, মাওলানা সাইফুর রহমান কাবুলি, মাওলানা ওহিদ আহমদ ফয়জাবাদি, মাওলানা মুহাম্মদ মিয়াঁ আনসারি, মাওলানা উজাইর গুল পেশোয়ারি, মাওলানা হাকিম নুসরাত হুসাইন ফতেহপুরি, মাওলানা আবদুল বারি ফিরিঙ্গি, মাওলানা আবুল মাহাসিন সাজ্জাদ পাটনাবি, মাওলানা আহমদ সাঈদ দেহলবি, মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা হিফজুর রহমান সিওয়াহারবি, মাওলানা মুহাম্মদ মিয়াঁ দেহলবি, মাওলানা আত্তাউল্লাহ শাহ বুখারি, মাওলানা হাবিবুর রহমান লুধিয়ানভি, মাওলানা আহমদ আলি লাহোরি, মাওলানা আব্দুল হালিম সিদ্দিকি, মাওলানা নূরুদ্দীন বিহারি প্রমুখ স্বাধীনতার আকাশের ঐ উজ্জ্বল তারকারাজি, যারা ইংরেজদের দাসত্বের অন্ধকার কালো রাত ভেদ করে দেশের প্রতিটি শহর-বন্দর, অলি-গলি, গ্রাম-গঞ্জ, পাড়া-মহল্লা স্বাধীনতার ঝলমলে আলোয় ভরে দিয়েছিলেন।

কবি বলেন,
এরাই ভারত জাতির কল্যাণকামি অভিভাবক
আল্লাহ এদের যথাসময়ে সতর্ক করেছিলেন।

উপরে উল্লিখিত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় সকলেই মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। দু-এক জন যদিও সরাসরি কোন মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন না, তবে অবশ্যই কোনো না কোনো আলেমের সংস্পর্শে থেকে ইলম অর্জন করেছেন। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের গোড়াপত্তন করেছিলেন। হজরত শাহ আবদুল আজিজ সাহেব অতঃপর সাইয়িদ আহমদ শহিদের নেতৃত্বে সংগ্রাম করেন। এবং তাদের পরেও স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যান। এরাই ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহে সশরীরে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এরাই স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দি এবং ইমামুল হিন্দ মাওলানা আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে যোগদান করেন। এই মোল্লাদের আত্মত্যাগের ইতিহাস জানতে হলে, ধারাবাহিক কিছু ঘটনার দিকে আমাদের নজর বুলানো দরকার।

খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দির শেষভাগে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা ভারতে এসেছিল। ১৬০১ সালে রাণী এলিজাবেথের অনুমতিক্রমে ১০০ জন ব্যবসায়ী ত্রিশ হাজার পাউন্ডের এক বিশাল অর্থ বিনিয়োগ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে একটি বাণিজ্যিক কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে। বাংলাতে এর প্রধানকেন্দ্র বানায়। অতঃপর প্রায় দেড়শ বছর ধরে কোম্পানি শুধুমাত্র ব্যবসা-বাণিজ্যে করেছিল। কিন্তু যখনই হজরত আওরঙ্গজেব আলমগীর এবং মোয়াজ্জম শাহের পর মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দেশটিতে রাজনৈতিক অরাজকতা সৃষ্টি হওয়ার ফলে খন্ডে খন্ডে বিভক্ত হয়ে যায়, ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি তার মুখোশ খুলে ফেলে আর সরকার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ শুরু করে। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী প্রকাশ্যে মাঠে নামে। জাতির কলঙ্ক, ইসলামকে অপমানকারি, ভারতের কুখ্যাত ব্যক্তি মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা পরাজয় বরণ করে এবং ব্রিটিশরা সমগ্র বাংলা দখল করে নেয়। তারপর ১৭৬৪ সালে নবাব সুজা-উদ-দৌলা বক্সারের যুদ্ধে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পরাজিত হন এবং বিহার ও বাংলা ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ১৭৯২ সালে স্বাধীনতার সূর্য সন্তান বীর বাহাদুর সুলতান টিপুর শহিদ হওয়ার পর ব্রিটিশরা মহীশূরও দখল করে নেয়। ১৮৪৯ সালে পাঞ্জাবও কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে আসে। একইভাবে, সিন্ধু, আসাম, বার্মা, আউধ, রোহিলখণ্ড, দক্ষিণ দোয়াবা, আলিগড়, উত্তর দোয়াবা, মাদ্রাজ এবং পান্ডচারি ইত্যাদি ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। একসময় দিল্লিও কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যায় আর শুধুমাত্র নামকাওয়াস্তে মুঘল সাম্রাজ্যের শাসন চলতে থাকে। ইংরেজরা এসকল এলাকা দখল করতে কেমন নির্যাতন নিপীড়ন চালিয়েছে, তা মিসেস আ্যানি ভেসান্ট নিজ বইয়ে সাবলীল ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি লেখেন, 'কোম্পানি সৈন্য দিয়ে নয় বরং ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে যুদ্ধ করেছিল। ইংল্যান্ড তার তলোয়ার দিয়ে ভারত জয় করেনি, বরং ভারতিয়দের তরবারি, ঘুষ, ষড়যন্ত্র, ভন্ডামি এবং চুড়ান্ত পর্যায়ের দ্বিমুখী আচারণ আর বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে এক দলকে অন্য দলের সাথে যুদ্ধ নামিয়ে দেয়। অতঃপর দুই দল যখন পারস্পরিক যুদ্ধে ব্যস্ত থাকে, তখন সুযোগ বুঝে দেশ দখল করে নিয়েছে। (স্বাধীনতার জন্য ভারতের প্রচেষ্টা, পৃ. 56)

পুরো ভারত উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্রমবর্ধমান নেটওয়ার্ক, তাদের শক্তিশালি কুপ্রভাব, আর আস্তে আস্তে ষড়যন্ত্রের জাল বিছানো সর্বপ্রথম লক্ষ্য করেন হজরত মাওলানা শাহ ওলিউল্লাহ দেহলভির প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। সাথে সাথেই তিনি অত্যন্ত দূরদর্শীতার সাথে গভীর পরিকল্পনা করে এর প্রতিকার ও প্রতিরোধের নীতিমালা প্রণয়ন করেন। বিস্তারিতভাবে নীতিমালার কর্ম-পদ্ধতি ও বাস্তবায়নের রুপ-রেখা বর্ণনা করেন। জনগণের মৌলিক অধিকার হরণকারি শাসনব্যবস্থা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে ভারতবাসিকে উৎসাহ প্রদান করেন। যে কোনো ধরনের শক্তি প্রয়োগ করতে বলেন। অতঃপর বড় ছেলে হজরত শাহ আব্দুল আজিজ দেহলবি তারই পরিকল্পনা মাফিক উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত সংগ্রাম গড়ে তোলেন।

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ফতোয়া জারি করেন এবং দেশকে 'দারুল হরব' তথা 'যুদ্ধক্ষেত্র' ঘোষণা করেন, যা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করার সমতুল্য ছিল। এই ফতোয়া দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে দেশের আনাচে কানাচে, প্রতিটি শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে। ১৮১৮ সালে মাওলানা সাইয়িদ আহমদ শহিদ, মাওলানা ইসমাইল দেহলবি এবং মাওলানা আব্দুল হাই বুধানবির পরামর্শে ভারতীয় জনগণকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তুলতে একটি দল গঠন করা হয়, যারা দেশের কোণায় কোণায় পৌঁছে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করেছিল। ১৮২০ সালে ইংরেজদের সাথে জিহাদ করতে মাওলানা সাইয়িদ আহমদ শহিদ রায়ব্রেলবির নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রওনা হয়। তিনি তাঁর দূরদর্শীতা ও যুদ্ধনীতির ভিত্তিতে সীমান্তবর্তী প্রদেশ পাঞ্জাবে মুক্তিযুদ্ধের মূল ঘাঁটি নির্মাণ করেন। উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা। কিন্তু পাঞ্জাবের রাজা ব্রিটিশদের অনুগত ছিলেন, প্রকাশ্যে জিহাদের বিরোধিতা করতেন, জিহাদকে ধূলিসাৎ করার সর্বপ্রকার ফন্দি আটতেন। তাই প্রথমে হযরত সাইয়িদ আহমদ শহিদ রহ. তার কাছে চিঠি পাঠান যে, 'আপনি আমাদের সমর্থন করুন, আমাদের সঙ্গ দিন, আমরা ব্রিটিশ শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয় লাভ করলে দেশ আপনার হাতে তুলে দেব। আমরা দেশ ও সম্পদ চাই না।' কিন্তু রাজা ব্রিটিশদের আনুগত্য ত্যাগ করেনি। ফলে তার সাথেও যুদ্ধ করা হয়। ১৮৩১ সালে বালাকোটের ময়দানে হযরত মাওলানা রায়ব্রেলবি শহিদ হন। কিন্তু তাঁর অনুসারিরা সাহস হারাননি বরং দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যান। ১৮৫৭ সালের যুদ্ধের জন্য সাইয়িদ সাহেবের অনুসারিগণ ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করতে এবং জনগণকে প্রস্তুত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বহু সংখ্যক উলামায়ে কেরাম পরিকল্পনা মাফিক সুসংগঠিত হয়ে সশরীরে অংশগ্রহণ করেন, যাদের সবারই যোগসূত্র ছিল হজরত শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি, হযরত শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলবি ও হযরত সাইয়িদ আহমদ শহিদ ব্রেলবির সাথে। এই যুদ্ধের জন্য জনগণকে উদ্‌বুদ্ধ করতে আলেমগণ সারা দেশে ওয়াজ, খুতবা ও বক্তৃতার বাজার উত্তপ্ত করেন এবং যুদ্ধের ব্যপক প্রচার-প্রসারের দায়িত্ব পালন করেন। সাথে সাথে সর্বসম্মত একটি ফতোয়া জারি করে ব্রিটিশদের উপর জিহাদকে ফরজে আইও ঘোষণা করেন। এই ফতোয়া 'জলন্ত আগুনে ঘি ঢালা'র কাজ করে এবং সারাদেশে দাউ দাউ করে স্বাধীনতার আগুন জ্বলে ওঠে। দেওবন্দের বড় বড় আলেমরা শামেলির ঐতিহাসিক যুদ্ধে সশরীরে অংশ নেন। হজরত মাওলানা কাসেম নানুতবি, হজরত মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি ও হাফিজ জামিন শহিদ, হযরত সাইয়িদুদ তায়েফা হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কির হাতে হাত রেখে মুক্তিযুদ্ধের শপথ গ্রহণ করেন। তারপর প্রস্তুতি শুরু হয়। হজরত হাজি সাহেবকে সেনাপতি, মাওলানা মুনির নানুতবিকে ডানপাশের সেনাদের কমান্ডার এবং হাফিজ জামিন শহিদকে বামপাশের সেনাদের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। তারা ইংরেজদের ওপর প্রথম হামলা চালায় শের-এ-আলি সড়কের পাশে এবং বিজয় লাভ করে। এতে অনেক যুদ্ধাস্ত্র ও বিভিন্ন প্রকার মালামাল হস্তগত হয়। আর দ্বিতীয় হামলা চালায় ১৮৫৭ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর শামেলির ময়দানে এবং জয়লাভ করেন। একসময় খবর এলো যে, সাহারানপুর থেকে কামান শামেলিতে পাঠানো হয়েছে। এখন মাঝপথে আছে। তৎক্ষণাৎ হযরত হাজি সাহেব মাওলানা গাঙ্গুহিসহ চল্লিশ-পঞ্চাশ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল তৈরি করলেন। শামেলির রাস্তার দুধারে বিশাল ঘন বাগান ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা সেই বাগানে লুকিয়ে থাকল। যখন ইংরেজ সৈন্যরা কামান নিয়ে বাগানে পৌঁছল, তখন তারা একসাথে অতর্কিত গুলি চালায়। ইংরেজ সৈন্যরা আতঙ্কিত হয়ে কামান রেখে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে হাফিজ জামিন শহিদ হন। ব্রিটিশরা সাইয়িদ হাসান আসকারি সাহেবকে গ্রেফতার করে সাহারানপুরে নিয়ে গুলি করে শহিদ করে আর হজরত রশিদ আহমদ গাঙ্গুহিকে মুজাফফর নগর জেলে বন্দি করে। হজরত মাওলানা কাসেম নানুতবি ভবিষ্যৎ যুদ্ধপরিকল্পনা ও কৌশল নির্ধারণের জন্য আত্মগোপনে চলে যান।

১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ নানা কারণে ব্যর্থ হয় এবং স্বাধীনতাকামিদের উপর ভয়াবহ নৃশংসতার পাহাড় ভেঙে পড়ে। তাদের মধ্যে মুসলমান, বিশেষ করে আলেমরা ছিল ব্রিটিশদের নিপীড়নের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। কারণ, তারা মুসলমানদের কাছ থেকেই ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল আর এখন আলেমরাই তাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে। আর একথাই ১৮৫৭ সালের চৌদ্দ বছর আগে ভারতের গভর্নর জেনারেল বলেছিলেন যে, 'মুসলমানরাই মূলত আমাদের প্রতিপক্ষ। সুতরাং মুসলমান থেকে সাবধান।' ব্রিটিশদের এই নিপীড়নের শিকার হয়েছিল দুই লাখ মুসলমান। যার মধ্যে শুধু মাত্র আলেম ছিলেন সাড়ে একান্ন হাজার। ইংরেজরা আলেমদের এতো বড় শত্রু ছিল যে, দাঁড়ি টুপি দেখলেই ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিত। কখনো শূকরের চামড়ায় ভরে সেলাই করে জলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করা হতো। কখনো কখনো শূকরের চর্বি তাদের শরীরে লাগিয়ে তারপর আগুন লাগিয়ে দিত।

এডওয়ার্ড থমসন সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, শুধুমাত্র দিল্লিতেই পাঁচশ আলেমকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। (রেশমি রুমাল, পৃ. 45)। পুরো দিল্লি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। চারদিকে ছিল লাশের মিছিল। উর্দু ভাষার প্রসিদ্ধ কবি মির্জা গালিব এই নির্যাতনের চিত্রায়ন করতে গিয়ে বলেন,
চৌক যাকে বলা হতো, সেটা আজ রণক্ষেত্র হয়েছে।

ঘরগুলো শুধু মাত্র জীবিতদের নমুনা স্বরুপ দাঁড়িয়ে আছে।
দিল্লি শহরের প্রতিটি মাটি কণা
শুধু মুসলমানদের রক্ত ​​পিপাসু।

দিল্লি, কলকাতা, লাহোর, মুম্বাই, পাটনা, আমবালা, এলাহাবাদ, লাখনৌ, সাহারানপুর, শামেলিসহ সারা দেশে মুসলমান ও অন্যান্য মাজলুম ভারতিয়দের মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিল। (দেখুন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং বিদ্রোহি উলামায়ে কেরাম।)

এই যুদ্ধে ব্যর্থতার প্রধান কারণ ছিল অর্থ ও জনবলের ঘাটতি এবং বিভিন্ন দল ও সংগঠনের কমতি। তাই আকাবিরে উলামায়ে দেওবন্দ অনেক চিন্তা ভাবনার পর ১৮৬৬ সালে দেওবন্দ এলাকায় 'দারুল উলুম দেওবন্দ' নামে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এর উদ্দেশ্য ধর্মীয় শিক্ষার পঠন-পাঠন হলেও মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিল ধর্ম, জাতি ও দেশের কল্যাণে এমন আদর্শ মানুষ গড়ে তোলা, যারা দেশ ও জাতির নেতৃত্ব দিতে পারে—স্বাধীনতার এই কাফেলাকে সফলতার সাথে গন্তব্যে পৌছাতে পারে।

তাই তো দারুল উলূমের প্রথম ছাত্র খ্যাত শাইখুল হিন্দ হজরত মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দি, যিনি পরবর্তীতে দারুল উলূমের শিক্ষক ও শিক্ষা প্রধান নির্বাচিত হন একবার তিনি বলেন, 'আমার সম্মানিত শিক্ষক মহোদয় হজরত নানুতবি রহ. এই মাদ্রাসা কি শুধুমাত্র পঠন-পাঠন ও শিক্ষা-দীক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন? এই মাদ্রাসা আমার চোখের সামনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমার জানামতে, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহে ব্যর্থতার পরে এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। যাতে এমন একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা যায়, যার তত্ত্বাবধানে ১৮৫৭ সালের ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠার জন্য জনগণকে প্রস্তুত করা যায়। (মাসিক দারুল উলুম, জুমাদিউস সানি ১৩৭২ হিজরি)।

শাইখুল হিন্দের এই কথা থেকে বুঝা যায় যে, দেশ ও জাতির সেবা এবং স্বাধীনতার চেতনা ধারণ করা দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। এরপর দারুল উলুম দেওবন্দের অনুসরণ-অনুকরণ করে সারা বিশ্বে যত মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হয়েছে সবারই প্রধান লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে এটাই রয়েছে যে, ধর্ম, দেশ ও জাতির উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে এমন ব্যক্তি ও জনবল তৈরি করা। তারপর আকাবিরে দারুল উলূম দেওবন্দ দেশের নির্মাণ ও উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালনের জন্য 'জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ' প্রতিষ্ঠা করেন, যা দারুল উলুম দেওবন্দের রাজনৈতিক অঙ্গ সংগঠন। জমিয়ত নেতারা জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা ও স্বাধীনতার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

জমিয়ত তার প্রস্তাবের মাধ্যমে কংগ্রেসেরও আগে 'কুইট ইন্ডিয়া (ভারত ছাড়ো)' এবং 'হিন্দুস্তান ছোড়ো (ভারত ছাড়ো)'র দাবি করেছিল। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ জমিয়ত ও কংগ্রেসের প্লাটফর্ম থেকে আর মাওলানা মুহাম্মদ আলি জওহর ও মাওলানা হাসরাত মোহানি অন্যান্য প্লাটফর্ম থেকে স্বাধীনতার জন্য যেই অক্লান্ত পরিশ্রম, মেহনত আর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তা দিনের আলোর মতো ঝলমলে স্পষ্ট।
অনুবাদক

স্বাধীনতা বিপ্লবের অগ্রনায়ক শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দি তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে ইংরেজ বিতাড়নে 'রেশমি রুমাল আন্দোলন' নামে যে অতুলনীয় ভূমিকা পালন করেছেন তার কিছু আলোকপাত করা দরকার। ১৮৫৭ সালে ব্যর্থতার পর দেশের স্বাধীনতার জন্য ব্যপকভাবে এই আন্দোলন শুরু হয়।

প্রথমে হজরত শাইখুল হিন্দ দেওবন্দের ছাত্রদের নিয়ে 'ছামারাতুত তারবিয়া' নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর 'জমিয়তুল আনসার' নামে আরেকটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এর অধীনে ছাত্রদের সুসংগঠিত করা হয় ও প্রশিক্ষণ দিয়ে শক্তিশালি করে গড়ে তোলা হয়। তাদের মধ্যে অনেকেই কাবুল ও সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দা ছিল। হজরত সাইয়িদ আহমদ শহিদের আন্দোলনের প্রভাব সেখানে এখনও বাকি ছিল।

শাইখুল হিন্দ ঐ এলাকাকেই নিজের এই আন্দোলনের কেন্দ্র ঘোষণা করেন। পরিকল্পনা এই ছিল যে, তাদের মন ও মস্তিষ্কে মুক্তিযুদ্ধের উৎসাহ, উদ্দীপনা, আগ্রহ, ভাবনা ভরে দিতে হবে। আফগান সরকারকে ভারতের মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে রাজি করাতে হবে এবং তুর্কি সরকারের সাথে যোগাযোগ করে ভারতে ব্রিটিশ সরকারকে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। আর দেশের অভ্যন্তরে গোপনে গোপনে বিদ্রোহ ও বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়ে দিতে হবে।

একসাথে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত আক্রমণ‌ করে ব্রিটেন সরকারকে ভারত ছাড়তে বাধ্য করতে হবে। এজন্য হজরত শাইখুল হিন্দ দিল্লি, লাহোর, পানিপথ, দিনপুর, অমৃতসর, করাচি, আতমানঝাই, ঢাকা প্রভৃতি শহরে এই আন্দোলনের উপকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। মিশনের সফলতার জন্য বার্মা, চীন, ফ্রান্স ও আমেরিকায় প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে তাদের সমর্থন লাভ করেন। তিনি মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধিকে কাবুলে অবস্থান করে কাজ করার নির্দেশ দেন এবং নিজে পবিত্র ভূমি হিজাজে চলে যান। যাতে সেখানকার উসমানি খিলাফতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাৎ করে ভারতীয়দের অসহায়ত্ব ও স্বাধীনতার প্রয়োজনীতা তাদের বুঝাতে পারেন এবং তুরস্ককে ব্রিটিশ সরকারের উপর আক্রমণ করার জন্য রাজি করাতে পারেন। তাই তিনি গভর্নর গালিব পাশার সাথে দেখা করলে তিনি সর্বপ্রকার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

মদিনায় অবস্থানরত তুরস্কের যুদ্ধমন্ত্রী আনোয়ার পাশার সাথেও সাক্ষাত করেন এবং মন্ত্রী পরিপূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এই আন্দোলনে মাওলানা সিন্ধি একটি রেশমি রুমালের উপর গোপন চিঠি তৈরি করেন, তাই এটিকে 'রেশমি রুমাল আন্দোলন' বলা হয়। এই আন্দোলনে হজরত শাইখুল হিন্দ ছাড়াও শাইখুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি, মওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধি, হাজি তরঙ্গঝাই, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা আব্দুল রহিম রায়পুরি, মাওলানা খলিল আহমদ সাহারানপুরি, মাওলানা সাদিক করাচবি, আব্দুল গাফ্ফার খান সারহাদি, মাওলানা আহমেদ আলি লাহোরি, মাওলানা হাসরাত মোহানি, মওলানা মুহাম্মদ আলি জওহর, মাওলানা উজাইর গুল, মাওলানা বরকতুল্লাহ ভোপালি এবং অমুসলিম সদস্যদের মধ্যে ছিলেন রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ সিং, ডাঃ মথুরা সিং, এপিপি আচার্য প্রমুখ অংশগ্রহণ করেছিলেন।

এই গোপন আন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও সূক্ষ্ম কর্মপদ্ধতি ফাঁস হওয়ায় আর হজরত শাইখুল হিন্দের গ্রেফতারের কারণে রেশমি রুমাল আন্দোলন সাফল্যের দোরগোড়ায় এসে ব্যর্থ হয়ে গেল। কিন্তু এই আন্দোলনের ফলে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সাথে স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের একটি শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে ওঠে।

হজরত শাইখুল হিন্দের আরেকটি কৃতিত্ব হলো, তিনি খিলাফত কমিটি ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্ল্যাটফর্ম থেকে তাদেরই তহবিল থেকে খরচ করে গান্ধিজিকে সমগ্র ভারত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পরিচিত করিয়েছিলেন এবং হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেন।

এই মুহূর্তে শাইখুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানিকেও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করা দরকার। তিনি হজরত শাইখুল হিন্দের পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশের স্বাধীনতা ও উন্নতি-উন্নয়ন-অগ্রগতির পিছনে সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। এবং জমিয়ত ও কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে ভারতীয়দের জন্য যেই অতুলনীয় অসামান্য অবদান রেখেছেন, তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

তিনি ১৯২০ সালে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের জনসভায় উচ্চ কণ্ঠে স্পষ্ট ভাষায় কয়েকটি দৃঢ় সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ব্রিটেন সরকারের সাথে সকল প্রকার বন্ধুত্ব ও সাহায্যের সম্পর্ক-লেনদেন সম্পূর্ণ হারাম এবং নিষিদ্ধ। সুতরাং আজ থেকে আমরা
১/ ইংরেজদের অনুগ্রহমূলক ও সম্মানজনক সকল পদ থেকে অব্যাহতি দিব।
২/ ব্রিটিশ কাউন্সিলের সদস্যপদও ত্যাগ করব।
৩/ ধর্মের শত্রু ব্রিটিশদের কোনো বাণিজ্যিক লাভের সুযোগ দিব না।
৪/ স্কুল-কলেজে সরকারি সাহায্য গ্রহণ করব না।
৫/ ধর্মের শত্রুদের সেনাবাহিনীতে চাকুরী করা হারাম ও নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হবে।
৬/ সরকারি আদালতে কোনো মামলা নিয়ে যাব না।
পরবর্তীতে ১৯২১ সালের জুলাই মাসে করাচিতে খিলাফত আন্দোলনের জনসভায়ও তিনি উপরোক্ত সিদ্ধান্তগুলি ঘোষণা করেছিলেন, মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর, ডঃ সাইফুদ্দিন কুচলুসহ অনেকেই যার জোর সমর্থন করেছিলেন।

ফলে হযরত মাদানিকে গ্রেফতার করা হয়। ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২১ সালে করাচির আদালতে তিনি বুক টান করে দাঁড়িয়ে বীরের মতো কোনো প্রকার ভয়ডরহীন এক দীর্ঘ বক্তব্য দেন। এবং সেখানেও উপরোক্ত বিষয়গুলোর পুনরাবৃত্তি করে বলেন যে, ব্রিটিশ সরকারের সেনাবাহিনীতে চাকরি হারাম। যদি সরকার আমাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ করতে প্রস্তুত হয়, মুসলমানরা তাদের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকবে এবং আমিই প্রথম ব্যক্তি হব, যে নিজ জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকবে। এই বক্তব্যের পর স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর হযরত শাইখুল ইসলামের পায়ে চুম্বন করেন। (চেরাগ মুহাম্মদ পৃ. ১১৫)।

জমিয়তের প্লাটফর্ম থেকে স্বাধীনতা ও পরবর্তীতে দেশের উন্নয়নে উজ্জ্বল ভূমিকা পালনকারী মহান আলেমদের মধ্যে মাওলানা আব্দুল বারি ফিরিঙ্গি মহল্লি, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মুফতি কেফায়াতুল্লাহ দেহলবি, মাওলানা সাজ্জাদ বিহারি, মাওলানা সাইয়িদ সুলায়মান নদবি, আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি, মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানি, শাহ মঈনুদ্দিন আজমেরি, মাওলানা আব্দুল হক মাদানি, মাওলানা সাইয়িদ মুহাম্মদ মিয়াঁ দেওবন্দি, মাওলানা হিফজুর রহমান সিউহারবি, মাওলানা ফখরুদ্দিন আহমদ মুরাদাবাদি, মাওলানা আহমদ সাঈদ দেহলবি প্রমুখের নামও রয়েছে।

কবি বলেন, এই প্রেম বাগানের পাগলরা সব পথ দিয়েই আল্লাহ তাআলার কাছে পৌঁছেছিল। তাই তো বাগানের দেওয়াল থেকে শুরু করে জেলখানা পর্যন্ত সর্বত্রই আমাদের গল্প চর্চিত।

দেশের স্বাধীনতার জন্য ত্যাগ স্বীকারকারি মহান আলেমদের ঐতিহাসিক অবদান একটু লম্বা করে বর্ণনা করা হয়েছে। কেননা, প্রকৃতপক্ষে সুখ-শান্তি, নিরাপদ ও নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ভরা স্বাধীনতার এই বাগান উলামায়ে কেরাম নিজেদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে সিঞ্চন করেছেন। তাই তো কবি বলেন,

এই বাগান বাঁচাতে আমরাই প্রথম রক্ত ​​দিয়েছিলাম।
আর এখন বসন্তকাল আসতেই বলে আমাদের প্রয়োজন নেই।

প্রয়োজন থাকবে তো দূরে থাক, ক্ষমতাসীন শাসক ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টিকারী দলের লোকেরা তো তাদের নাম উল্লেখ করতে চায় না। তবে এটা আমাদের গুরুদায়িত্ব যে, দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠ বীর মহানায়কদের মনের গভীর থেকে শ্রদ্ধা জানানো। তাদের গৌরবময় কৃতিত্ব ও স্বর্ণালি ইতিহাস জানা। নিজেদের জীবন চলার পথে পদে পদে তাদের বর্ণাঢ্য আলোকিত জীবনের প্রতিটি দিক অনুসরণ করা।

কবি বলেন, এরা সেই বীর বাহাদুর, এরাই সেই মুক্তিযোদ্ধা
যাদের রক্তমাখা ত্যাগের বিনিময় এদেশ পেয়েছে স্বাধীনতা।
তাদের আমরা ভুলে যাব, এটা ক্ষমার অযোগ্য শাস্তি
কেননা, এমাটি বেঁচে আছে বুকে জড়িয়ে তাদের অনুভূতি।

সূত্র: মাসিক দারুল উলুম, সেপ্টেম্বর ২০০৬।

-এটি


সম্পর্কিত খবর



সর্বশেষ সংবাদ