মোহাম্মাদ হুজাইফা
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার যে আন্দোলন পরবর্তী সময়ে অভ্যুত্থানে রূপ নেয়- তাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা। এই আন্দোলনে শয়ের কাছাকাছি মাদরাসাপড়ুয়া প্রাণ দেন। আহত হন শত শত। প্রত্যাশা ছিল হাজারও ছাত্র-জনতার প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত নতুন এই বাংলাদেশে অন্তত কওমি মাদরাসাপড়ুয়ারা আগের মতো সেই বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হবে না। কিন্তু সেই আশা বাস্তবায়নের কোনো আভাসও আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি অফিসের দরজায় ‘এখানে কওমী মাদ্রাসার সনদ সত্যায়ন করা হয় না।’ লেখা নোটিশ ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। এটাকে কওমি মাদরাসাপড়ুয়াদের প্রতি চরম বৈষম্য হিসেবে আখ্যায়িত করছেন নেটিজেনরা। এখানে কয়েকজনের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হলো-
লেখক ও চিন্তক মনযূরুল হক লিখেন- ‘সরকার হলেন এলিট শ্রেণির মানুষের জন্য, নিম্ন বর্ণের জন্য না। আর আমরা মানে কওমিরা হলাম বাংলাদেশের নম শূদ্র টাইপের নিম্ন বর্গীয় নাগরিক। এলিটরা যা করে, তাতেই সরকারের অনেক লাভ। কওমিদের দিয়ে সরকারের কোনও লাভ নাই, বরং সরকার সম্ভবত আশংকা করছে, কওমী সনদের সত্যিকারেরর বাস্তবায়ন হলে তাদের বাজেটে আরও অর্থ খরচ করা লাগবে। এমনিতেই শিক্ষাখাতে বরাদ্দ আগের চেয়ে কম। তা ছাড়া সরকারি মসজিদের ইমামদের মাসোয়ারাও কমানো হয়েছে বলে শুনলাম। সেখানে এই নমশুদ্র কওমিদের বিষয়টি সরকারের কাছে উৎপাত মনে হচ্ছে সম্ভবত। এই জন্যই বৈষম্যটা রয়ে গেছে।
না হলে দুইবার গেজেট হওয়া এবং ২০১৯ সালে সংসদে আইন পাশ হওয়া একটি সনদের স্বীকৃতির পরও কোনো সভ্য দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামনে এমন স্টিকার লাগানো থাকতে পারে না। নিশ্চয় কওমি শিক্ষার্থীরা নিয়মিত মন্ত্রণালয়ে গিয়ে জ্বালাতন করছে। সেই জ্বালাতন থেকে বাঁচতেই এই ব্যবস্থা নিয়েছে তারা।
একটা আইন হবার পর, আইনের স্টেক হোল্ডার যারা আছেন, তাদের প্রত্যেকটি জায়গায় সেই আইনের অনুলিপি চলে যাবার কথা। এবং সেই আইন অনুপাতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। কিন্তু এই দেশের রাষ্ট্রীয় পরিসরে বৈষম্য রন্ধ্রে রন্ধ্রে জেঁকে আছে। শিক্ষামন্ত্রণালয়ের আমলা থেকে নিয়ে একজন পিয়ন পর্যন্ত ওখানে গেলে ধমক দেয়। এটা কিভাবে সম্ভব হলো? একই দেশের নাগরিকদের সঙ্গে তো দুই ধরনের আচরণ হওয়ার কথা না।
তাহলে এমন আচরণ কেন হচ্ছে? হচ্ছে এই কারণে যে, এ দেশে কওমি শ্রেণিকে নিম্নবর্গের মানুষ বলে গণ্য করা হয়।
‘নতুন বাংলাদেশে বৈষম্য নয়, চাই ন্যায়। আমরা কওমিদের জন্য সম্মান চাই—ভিক্ষা না’ এই বলে মন্তব্য করেন সাংবাদিক মুফতি আবদুল্লাহ তামিম। নিজ প্রোফাইলে তিনি তিনটি দাবি তুলে ধরে বলেন-
‘একটি দেশের উন্নয়ন কেবল রাস্তা-ঘাট বা ভবন দিয়ে মাপা যায় না। একটি জাতির অন্তরাত্মা মাপা যায় তার শিক্ষাপদ্ধতির প্রতি সমমর্যাদা ও সন্তানদের প্রতি সমান আচরণ দিয়ে। অথচ আমাদের চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে, কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের প্রতি চলছে স্পষ্ট বৈষম্য। আজও সরকারি প্রতিষ্ঠানে বড় করে লেখা থাকে— ‘এখানে কওমি মাদরাসার সনদ সত্যায়ন করা হয় না।’এ এক বাক্যেই প্রমাণ হয়, এই বাংলাদেশে কওমি শিক্ষার কোনো সম্মান নেই!’
অথচ স্বাধীনতা ও ইসলাম রক্ষার আন্দোলনে শহীদ হয়েছিলেন বহু আলেম ও কওমি ছাত্র। CSS ফাউন্ডেশনের তালিকা অনুযায়ী শহীদ হয়েছেন ৪২ জন। তাদের রক্তে যে দেশ, সেই দেশের অফিসে আজ বলা হয়— ‘তোমার সনদের কোনো দাম নেই।’
আমরা চাই—
১. কওমি শিক্ষার পূর্ণ মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি
২. সব দপ্তরে কওমি সনদের মূল্যায়ন ও চাকরির সুযোগ
৩. শহীদ আলেম ও শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি
‘নতুন বাংলাদেশে বৈষম্য নয়, চাই ন্যায়। আমরা কওমিদের জন্য সম্মান চাই—ভিক্ষা না।’
তরুণ কথাশিল্পী মুজিব হাসান তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন: ‘শিক্ষামন্ত্রণালয়ের দরজায় সাঁটানো এটা—আওমি রেজিমের দেওয়া মুলা। গন্ধ ছড়াচ্ছিল বলে ছুড়ে ফেলে দিল। কেননা আমরা যে বড় অপাঙক্তেয়! আর কয়দিন পরে হয়তো দেখতে পাব—স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দরজায় এভাবে সাঁটানো থাকবে- ‘এখানে কওমি মাদরাসাওয়ালাদের ত্যাগ-তিতিক্ষাকে মূল্যায়ন করা হয় না।’ তবুও জাগবে না বড়দের হুঁশ!!’
এমএইচ/