মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫ ।। ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ ।। ১ জিলকদ ১৪৪৬

শিরোনাম :
দেশে ফিরছেন খালেদা জিয়া, প্রস্তুত করা হচ্ছে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স শিক্ষার্থীদের সভা-সমাবেশ ও মিছিলে অংশগ্রহণ বন্ধের নির্দেশ নারী নীতিমালা নিয়ে জাতীয় সেমিনারে শীর্ষ আলেম-রাজনীতিকরা ‘মানবিক করিডোর’ প্রতিষ্ঠার আগে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করতে হবে সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে চায় বিএনপি : মির্জা ফখরুল ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি স্থগিত প্রতিহিংসা-প্রতিশোধ শান্তি বয়ে আনতে পারে না: আমীরে জামায়াত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে শাসন সংকট, মনোভাবের বিপর্যয় এবং সতর্কতার আহ্বান নিবরাস ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনে শিক্ষক নিয়োগ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পুলিশের প্রতি প্রধান উপদেষ্টার আহ্বান

শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে শাসন সংকট, মনোভাবের বিপর্যয় এবং সতর্কতার আহ্বান

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| ওলিউল্লাহ্ মুহাম্মাদ ||

শিক্ষা শুধু মেধার উন্নতি কিংবা তথ্য আহরণের নাম নয়; বরং নৈতিকতা, চরিত্রগঠন, সহনশীলতা ও আদব শিখানোর অন্যতম মাধ্যমও বটে। বিশেষত মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা, যার উদ্দেশ্য মানবজীবনকে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সাজানো এবং নৈতিক ভিত্তিতে উন্নত সমাজ গঠন করা, সেখানে শাসন ও সংশোধনমূলক শিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আজ মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষকের শাসন হজম করার মতো মানসিকতা ছাত্র-ছাত্রী ও গার্ডিয়ানদের মধ্যে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। শিক্ষকের শাসনকে উপদেশ ও কল্যাণের অংশ মনে করার পরিবর্তে অপমান, অবমাননা বা নির্যাতন মনে করা হচ্ছে। ফলে মাদ্রাসার ঐতিহ্যগত সুন্দর পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।

বর্তমানে মাদ্রাসাগুলোর বাস্তব চিত্র হলো, সামান্য শাসনেও ছাত্রদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের চেহারায় বিদ্রোহ, মুখে অবাধ্যতা, আচরণে শিক্ষকের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ পাচ্ছে। কোনো ছাত্র একটু সংশোধনের মুখোমুখি হলে সে মুখের উপর তর্কে লিপ্ত হচ্ছে, শিক্ষকের সমালোচনায় লিপ্ত হয়ে পরিবেশকে কলুষিত করছে। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, সামান্য শাসনে কষ্ট পেয়ে ছাত্র মাদ্রাসা পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছে কিংবা বাড়িতে গিয়ে গার্ডিয়ানদের প্ররোচিত করে শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। গার্ডিয়ানরাও অনেক ক্ষেত্রে অফিসিয়ালভাবে সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে উস্কানিমূলকভাবে বিষয়টিকে ঘোলাটে করে তুলছেন, মাদ্রাসার সম্মানহানী ঘটাচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাত্র ও গার্ডিয়ানদের হিংস্র আচরণ পর্যন্ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে — প্রকাশ্যে শিক্ষকের সাথে দুর্ব্যবহার, অপমান, এমনকি শারীরিক আক্রমণের ঘটনাও ঘটছে। পরিণামে শিক্ষকসমাজের মর্যাদা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং মাদ্রাসার পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। মিডিয়াতে এসব ঘটনা অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপিত হওয়ার ফলে পুরো ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থার ভাবমূর্তি কলুষিত হচ্ছে।

এই সংকটের পেছনে শিক্ষকসমাজের কিছু দুর্বলতা ও কৌশলগত ভুলও অবহেলা করা যায় না। অনেক শিক্ষক শাসনের ক্ষেত্রে মাত্রার অতিরিক্ততা করছেন, নিয়ন্ত্রণহীন রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন, কখনো কখনো প্রহারে ইখলাসের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। ছাত্রদের প্রতি দয়া ও কল্যাণকামিতার মনোভাব বজায় না রেখে শাসনকে কর্তৃত্ব প্রদর্শনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আরও বড় সমস্যা হলো, ছাত্রদের শাসন হজম করার মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়নি। তাদেরকে শিক্ষকের সম্মান, মর্যাদা ও শাসনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে যথাযথ ধারণা প্রদান করা হয়নি। আকাবিরদের (প্রথম যুগের আলিমদের) জীবনী পাঠ ও আদর্শ শিক্ষার চর্চা কমে যাওয়ায় ছাত্রদের মনের ভেতর শিক্ষকের প্রতি ভালোবাসা, ভয় ও শ্রদ্ধার সমন্বিত অনুভূতি গড়ে ওঠেনি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ছাত্রদের সাথে শিক্ষকদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের দুর্বলতা, যা তাদের মধ্যে হৃদ্যতা ও আস্থা সৃষ্টিতে বাধা দিচ্ছে।

অন্যদিকে ছাত্র ও গার্ডিয়ানদের ভুলত্রুটিও এ সংকটকে গভীরতর করছে। আজ অনেক ছাত্র উস্তাদকে কল্যাণকামী মুরব্বি না ভেবে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে। তাদের মনে শিক্ষকের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা, ভয় ও ভালোবাসার অভাব পরিলক্ষিত হয়। উস্তাদের শাসনকে তারা পরামর্শ বা সংশোধনের অংশ না মনে করে অপমান ও নির্যাতন মনে করে। তাদের মধ্যে সহনশীলতা ও আত্মসমালোচনার গুণাবলি মারাত্মকভাবে কমে গেছে। এর ফলে সামান্য একটি ঘটনার উপর ভিত্তি করে শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, অভিযোগ, এমনকি সামাজিক আন্দোলনও সংঘটিত হচ্ছে, যা নৈতিক ও মানবিকভাবে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।

এই সংকটময় অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষক, ছাত্র ও গার্ডিয়ান — তিন পক্ষেরই দায়িত্বশীল ভূমিকা অপরিহার্য। শিক্ষকদের প্রথম কাজ হলো ছাত্রদের শাসন সহ্য করার উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। তাদের অন্তরে শিক্ষকের মর্যাদা, শাসনের গুরুত্ব ও সংশোধনের সৌন্দর্য সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি করতে হবে। ছাত্রদের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে শিক্ষা দিতে হবে। প্রহার বা শাসনের ক্ষেত্রে সংযম ও ইখলাস বজায় রাখা চাই; প্রয়োজনে ভাষাগতভাবে বা দৃশ্যত শাসন করার পরিবর্তে মানসিক সংশোধন ও ভালোবাসার মাধ্যমে সংশোধনের কৌশল রপ্ত করতে হবে। আকাবিরদের জীবনী পাঠের মাধ্যমে ছাত্রদের মনে আদর্শের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করতে হবে।

ছাত্র ও গার্ডিয়ানদের দিক থেকেও মানসিকতার পরিবর্তন অপরিহার্য। শিক্ষকদের শুধু একাডেমিক গাইড বা চাকরিজীবী মনে না করে কল্যাণকামী অভিভাবক মনে করতে হবে। তাদের শ্রদ্ধা, সম্মান এবং সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পূর্ণ সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। গারর্ডিয়ানদের উচিত, সন্তানকে শিক্ষকের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার চেতনা দিয়ে লালন করা এবং কোনো ঘটনা ঘটলে আবেগের বশবর্তী না হয়ে যথাযথভাবে বিষয়টি বুঝে নেওয়া।

সবশেষে বলা যায়, শিক্ষা শুধু পাঠ্যপুস্তকের সীমায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি নৈতিক চরিত্র ও সুন্দর জীবন গঠনের মাধ্যম। মাদ্রাসার ঐতিহ্য ও পরিবেশ রক্ষা করতে হলে সকল পক্ষকে দায়িত্বশীল হতে হবে। শিক্ষককে চাই গভীর মমতা ও প্রজ্ঞা, ছাত্রকে চাই ধৈর্য ও শ্রদ্ধা, গার্ডিয়ানকে চাই সহানুভূতি ও সুবিবেচনা। তাহলেই গড়ে উঠবে একটি উন্নত, নৈতিকতাসম্পন্ন, আলোকিত মাদ্রাসা শিক্ষা-ব্যবস্থা, যা দেশ ও জাতির জন্য হবে প্রকৃত আশীর্বাদ।

লেখকঃ ফাজেলে জামি'আ রাহমানিয়া আরাবিয়া ঢাকা।
নাজিমে তালিমাত, পারখাজুরা মাদরাসা, মণিরামপুর, যশোর। 


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ