সোমবার, ০৪ আগস্ট ২০২৫ ।। ২০ শ্রাবণ ১৪৩২ ।। ১০ সফর ১৪৪৭

শিরোনাম :
ইসলামি দলগুলোর ঐক্য-সমঝোতা কতদূর? গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে খেলাফত মজলিস ঢাকা মহানগরী উত্তর-এর সমাবেশ  আদর্শিক বিরোধে গণ-অভ্যুত্থানে কারো অবদান অস্বীকার করা উচিত নয় : মাহফুজ আলম ইসলামি চার রাজনৈতিক দলের লিয়াঁজো কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত ‘স্বৈরতন্ত্র ও স্বৈরতান্ত্রিক বন্দোবস্তের স্থায়ী বিলোপের জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে’ মোবাইলে লাউডস্পিকারে কথা বলা; ইসলাম কি বলে: শায়খ আহমদুল্লাহ জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনতার বিস্ফোরণ: রাষ্ট্রপতি মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে ড. শোয়াইব আহমদের সৌজন্য সাক্ষাৎ ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করবেন প্রধান উপদেষ্টা সব ধরনের দূষণ রোধে আলেম-ওলামার সহযোগিতা চায় সরকার

ফিলিস্তিনি এক পিতার চোখে যুদ্ধ ও ক্ষুধার ভয়ংকর বাস্তবতা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ইনজামামুল হক 

গাজার বাসিন্দা ৪০ বছর বয়সী ইউসুফ আল-আজৌরি এখন একটি তাবুতে বাস করেন। সেখানে তার স্ত্রী, সাত সন্তান, মা ও বাবা থাকেন—সবাই মিলে দশজন। যুদ্ধের আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন এক সাধারণ ট্যাক্সিচালক। এখন তার জীবনের একমাত্র লড়াই: খাদ্যের জন্য বেঁচে থাকা। 

আমার সন্তানরা সবসময় কাঁদে ক্ষুধায়। রুটি, ভাত- কিছু একটা চাই খাওয়ার মতো। এক সময় ঘরে ছিল চাল-ডালের মজুদ। এখন সব শেষ। কোনোভাবে বেঁচে আছেন দাতব্য সংস্থার খাবারে। তাও পরিমাণে এত কম যে সন্তানেরা ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে।

যুদ্ধ ও বাস্তুচ্যুতি

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ইসরায়েলি বাহিনী উত্তর গাজায় আক্রমণ চালালে জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে ইউসুফের বাড়ি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। সেই থেকে পরিবার নিয়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন গাজা সিটির আল-সারায়া অঞ্চলের একটি অস্থায়ী তাবুতে।

জীবন যখন আর চলছিল না, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন যেকোনো মূল্যে খাদ্য সংগ্রহ করতে হবে।

প্রাণনাশের ভয়, তবুও ত্রাণের খোঁজে

২০২৪ সালের ১৮ জুন রাত ৯ টার দিকে পাশের তাবুর কিছু মানুষ প্রস্তুতি নিচ্ছিল ত্রাণ নিতে যাওয়ার। ইউসুফও ঠিক করেন, এই যাত্রায় যাবেন। ত্রাণ কেন্দ্রটি ছিল সালাহউদ্দিন রোডে, নেটজারিম করিডোরের কাছে। সেখানে যাওয়ার পথ যেন মরণফাঁদ! স্নাইপার, গুলি, গোলা আর মৃত্যু।

পাশের তাবুর খলিল হাল্লাস (৩৫) তাকে বলেছিলেন, ঢিলেঢালা পোশাক পরতে- যাতে দৌড়ানো সহজ হয়। একটা ব্যাগ নিতে, যাতে ক্যানজাত খাবার নেওয়া যায়। বাক্স নেওয়ার সুযোগ নেই ভিড়ের কারণে।

ইউসুফের স্ত্রী আসমা (৩৬) ও মেয়ে দুয়া (১৩) ত্রাণ সংগ্রহে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ইউসুফ তাদের নিষেধ করেন। সে জায়গা নারীদের জন্য আরও ভয়ংকর।

মৃত্যুর পথ পেরিয়ে ত্রাণ কেন্দ্র

তারা ছয়জন রওনা দেন—এক ইঞ্জিনিয়ার, এক শিক্ষক, কয়েকজন তরুণ। ১৭ জনের একটি টুক-টুক গাড়িতে ঠাসাঠাসি করে চড়ে যাত্রা শুরু। ভেতরে ছিল ১০-১২ বছর বয়সী শিশুরাও।

তারা নির্ধারিত পথ বাদ দিয়ে একটি বিকল্প বিপজ্জনক রুটে যান। পথে আলো জ্বালানো নিষেধ—স্নাইপাররা ঘাপটি মেরে থাকে। অন্ধকারে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হয়, গুলির আওয়াজও যেন গায়ে এসে লাগে।

“এক যুবক ফোনের আলো জ্বালালেই গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কেউ সাহায্য করতে পারল না তাকে।”

এই অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যান ইউসুফ, কিন্তু পিছু ফেরার উপায় ছিল না। কারণ এই পথই তার সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারার শেষ পথ।

ত্রাণের জন্য যুদ্ধ

রাত ২টার দিকে ত্রাণ কেন্দ্রের সবুজ আলো জ্বলে ওঠে। তখন হাজার হাজার মানুষ চারদিক থেকে ছুটে আসে। ইউসুফ বিস্ময়ে দেখেন, তার আগে এত মানুষ কীভাবে পৌঁছে গেছে!

“কেউ কেউ খাবার কেড়ে নিচ্ছিল। আমি একবার চালের বস্তা ধরেছিলাম, সঙ্গে সঙ্গে কেড়ে নেয় আরেকজন।”

ভিড়ের মধ্যে ইউসুফের চোখে পড়ে এক কিশোরী, সে পদদলিত হয়ে যাচ্ছিল। তিনি টেনে তাকে বাঁচান। কিন্তু নিজের জন্য মাত্র চারটি বিনসের ক্যান, এক কেজি বুলগার, আধা কেজি পাস্তা পেয়েছেন। সেটিও কিনা সারা রাত মৃত্যুর ভয় পেরিয়ে!

বেশিরভাগ মানুষ কিছুই পায়নি। অনেকে মাটি থেকে ছিটকে পড়া চাল তুলে নিচ্ছিলেন।

ত্রাণ কেন্দ্র থেকে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ইসরায়েলি সেনারা তাঁদের লক্ষ্য করে হাসছিল। কিছু সৈন্য ভিডিও করছিল, কিছু অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে ছিল।

মনে হচ্ছিল, স্কুইড গেমের মতো কেউ হয়তো আমাদের নিয়ে খেলা করছে। খাবার শেষ হতেই ধোঁয়ার গ্রেনেড ছোড়া হয়। তারপর শুরু হয় গুলিবর্ষণ।

৩৫টি মরদেহ, একটি প্রশ্ন

আল-আওদা হাসপাতালে গিয়ে তারা দেখেন, সেখানে এক কক্ষে ৩৫টি মরদেহ রাখা। প্রত্যেকেই গুলিতে মারা গেছেন—ত্রাণ নিতে গিয়ে। তাদের পরিবার ভাবছিল তারা খাবার নিয়ে ফিরবেন, অথচ তারা ফিরলেন লাশ হয়ে।

আমি ভেঙে পড়তে শুরু করলাম, এই পরিবারগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে। আমি মনে মনে ভাবলাম- কেন আমাদের মরতে বাধ্য করা হচ্ছে, শুধুমাত্র আমাদের সন্তানদের খাওয়ানোর জন্য?

এই ঘটনা ইউসুফের মানসিকতাকে বদলে দেয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, আর কখনও ত্রাণের জন্য এই যাত্রা করবেন না।

ধীর মৃত্যু

নিজে না খেয়ে সন্তানদের খাওয়ান ইউসুফ। দিনে একবেলা খাবার, আবার কখনও কিছুই না। এটা বেঁচে থাকার জীবন নয়। এটা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া।

এই বক্তব্য কেবল একটি ব্যক্তির নয়। এটি লাখো ফিলিস্তিনির কণ্ঠস্বর। ইসরায়েলি অবরোধ ও দখলদারির মধ্যেও তাদের মানবিক মর্যাদা, ন্যূনতম অধিকার, খাদ্য পাওয়ার জন্য এই সংগ্রাম বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেওয়ার মতো। একে উপেক্ষা করা মানেই মানবতার পতন।

সূত্র: মিডল ইস্ট আই

এমএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ