মাইশা জান্নাত
জীবন বড় অদ্ভূত। কখন যে কোন বাঁকে দাঁড়িয়ে সব হিসেব পাল্টে দেয়, তা কেউ বলতে পারে না। পাপের সাগরে ডুবে থাকা একজন মানুষও হঠাৎ খুঁজে পেতে পারে তওবার কূল, ফিরে আসতে পারে প্রভুর পথে। এমনই এক আলোয় ফেরা গল্প ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের ছাত্রী সায়মা ( ছদ্ম নাম ) —যার জীবনের মোড় ঘুরে যায় এক গভীর রাতে। কান্নার রাতে।
সায়মা ( ছদ্ম নাম ) বলেন, আজ আমি আমার জীবনের গত ছয় মাসের এক গভীর অভিজ্ঞতা আপনাদের শোনাতে চাই—একটি যাত্রার গল্প, ফিরে আসার গল্প। এমন দুটি স্বপ্নের কথা, যা আমার জীবন বদলে দিয়েছে।
কখনো এসব নিয়ে কারো সামনে কথা বলিনি। মুখ খুলতেও ভয় বা দ্বিধা ছিল। আজ বলছি এই আশায়—হয়তো আমার গল্পে একজন মানুষ হলেও অনুপ্রাণীত হবেন। তাতেই আমার জীবনের এই অধ্যায়টি সার্থক হবে।
আত্মপরিচয়ের দ্বিধা থেকে দ্বীনের আলোয়
আমি সবসময়ই লিবারেল ঘরানার একজন মেয়ে ছিলাম। টি-শার্ট, জিন্স, ওয়েস্টার্ন পোশাকে স্বচ্ছন্দ। কিন্তু একটা সত্য কখনো অস্বীকার করিনি—ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসগুলো মেনে এসেছি মনপ্রাণ দিয়ে।
কিন্তু স্রোতের বিপরীতে হাঁটার মতো সেই বিশ্বাস জীবনে বাস্তবায়ন করার মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। এই সমাজে সেটা খুব সহজও নয়।
রমজান মাসের আলো ও পর্দার সূচনা
রমজানের ১ তারিখ, কোনো চিন্তা-পরিকল্পনা ছাড়াই হিজাব পরা শুরু করি। ভেবেছিলাম, শারীরিক সমস্যার কারণে হয়তো এই আগ্রহ কখনো কমে যাবে—হিজাব ছেড়ে দেব।
কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করলাম—হিজাবের সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্টের মতো দূরারোগ্য সমস্যাগুলোও অনেকটা কমে গেছে।
এরপর ২ মে, খুব প্রিয় এক মানুষকে দ্বীনের পথে ফিরে আসতে দেখে আমারও ইচ্ছা হয়, বোরকা পরা শুরু করার। ছয়টি মার্কেট ঘুরে অবশেষে একটি পছন্দসই বোরকা কিনে আনলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম—যারা আমাকে সবসময় ওয়েস্টার্ন পোশাকে দেখেছে, তারা হঠাৎ এমন পরিবর্তনে কী ভাববে!
কিন্তু সমস্ত ভয়-লজ্জা ছেড়ে শুরু করি আমার ‘বোরকা জার্নি’।
স্বপ্নে এক অদ্ভূত ডাক
জুন মাসের একদিন, বোরকা না পরে সাধারণ পোশাকে নিউ মার্কেট ঘুরে এলাম। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙে এক বিস্ময়কর স্বপ্ন দেখে।
আমি, মা, খালা, নানু—মক্কার অদূরে এক হুজুরের খানকায় উপস্থিত। স্থানটি মাটির ওপর একতলা, নিচে তিনতলা—যেখানে হজের সময় ইন্তেকাল করা হাজিদের দেহ সংরক্ষণ করা হয় ।
সবাই পরিপূর্ণ পর্দায় আবৃত, শুধু আমি বেপর্দা। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠি—“আমি কেন এমন পবিত্র স্থানে এভাবে এসেছি?” লাশের সারি পেরিয়ে নিচে নামছি, নিজেকে আড়াল করার উপায় পাচ্ছি না। হুজুররা নামছেন, জানাজার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, আমি এক কোণে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছি লজ্জায়, তবুও আড়ষ্টতা কমছে না।
উপরে উঠে মা-নানুকে খুঁজে পেয়ে বলছি, “আমাকে একটা চাদর দিয়ে ঢেকে দাও, আমি এভাবে থাকতে পারি না!” ঠিক তখনই কেউ একজন আমার গায়ে জড়িয়ে দেয় মখমলের বড় একটি চাদর।
সেই মুহূর্তেই ঘুম ভেঙে যায়। ভোরের আলোয় বসে আমি কাঁদতে থাকি—বুঝতে পারি, এ কোনো স্বপ্ন নয়, এক অলৌকিক বার্তা।
আবার এক অদ্ভূত স্বপ্ন, আবার এক জাগরণ
কয়েকদিন পর আবার সেই আগের মত হয়ে যাচ্ছিলাম। আমি এক রাতে আল্লাহর দরবারে খুব করে দোয়া করি—“হে আল্লাহ, আমাকে আপনার নূরের পথে অটল রাখুন, আপনার পথ থেকে বিচ্যুত হতে দেবেন না।”
সেই রাতেই দেখি আরেকটি অদ্ভূত স্বপ্ন। এক অজানা রাস্তায় আমি ছুটছি। আশেপাশে শুধু লা’শ আর লা’শ—কাফনে মোড়ানো শত শত মৃতদেহ। আমি আতঙ্কে দৌড়ে এক গ্রামে গিয়ে পৌঁছি।
সেখানে কয়েকটা শিশু এসে হেসে বলছে, “তুমিই না সেই, যে হেদায়াত চাও কিন্তু সেই পথে থাকতে পারছ না?” সেই তীক্ষ্ণ হাসি, সেই তীর্যক প্রশ্ন আমাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেয়। আতঙ্কে ঘুম ভেঙে যায়।
সেই সকাল থেকে শুরু হয় ইসলামে আমার চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ—বোরকা ছাড়া আর কখনো বাইরে বের হইনি।
হেদায়াত চাওয়ার গল্প
অনেকে দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলো জানেন, বিশ্বাসও করেন। কিন্তু সামাজিক চাপ, লোকলজ্জা, পারিবারিক পিছুটান—এসবের কারণে দ্বীনের পথে সাহস করে আসতে পারেন না।
আমি শুধু একটি প্রশ্ন রাখতে চাই—আপনি কখনো আল্লাহর কাছে মন খুলে হেদায়াত চেয়েছেন?
আমি বিশ্বাসের সঙ্গে বলছি, তিনি আপনাকে হেদায়াত দিতে প্রস্তুত আছেন। শুধু আপনার আন্তরিক চাওয়ার অপেক্ষা।
আজ না হোক, কাল—অবশ্যই পাবেন। ইনশাআল্লাহ।
সূরা আন-নূরে আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ তাঁর নূরের দিকে যাকে ইচ্ছা হেদায়াত দেন।”
আপনি যখন তাঁর নূরের সন্ধান পাবেন, তখন সব কিছু সহজ হয়ে যাবে। যা এতদিন অসম্ভব বলে মনে হতো, তা-ই হবে আনন্দের।
আমি কোনো আলিমা নই, পারফেক্ট মুসলিমাও না। একাধারে ব্যর্থ আর অপরাধবোধে ভরা একজন সাধারণ মানুষ। ক্লাসে ফেল করা এক ছাত্রী যেমন ভাবে—“আরেকটু চেষ্টা করলে হয়তো পাস করতাম”—তেমনি আমিও ভাবি, আরেকটু আন্তরিক হলে দ্বীনের পথে হয়ত আরও আগে আসতে পারতাম।
আপনিও পারবেন। চেষ্টা করুন। অন্তর থেকে চাইলে, আন্তরিকভাবে চাইলেই আল্লাহ আপনাকে গ্রহণ করবেন।
আমি অনেক কিছু হারিয়েছি, কিন্তু দ্বীন—এটা কোনো কিছুর বিনিময়ে নয়। এই সেই দ্বীন, যার জন্য আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত।
জীবন গড়তে হবে এমনভাবে, যেন দুনিয়ার কিছুই আমাদের মনকে ভাঙতে না পারে। বরং যখন আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হই, তখনই যেন হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
লেখক: শিক্ষার্থী, আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া মাখজানুল উলুম খিলগাঁও
এমএইচ/