সোমবার, ০৪ আগস্ট ২০২৫ ।। ২০ শ্রাবণ ১৪৩২ ।। ১০ সফর ১৪৪৭

শিরোনাম :
ইসলামি দলগুলোর ঐক্য-সমঝোতা কতদূর? গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে খেলাফত মজলিস ঢাকা মহানগরী উত্তর-এর সমাবেশ  আদর্শিক বিরোধে গণ-অভ্যুত্থানে কারো অবদান অস্বীকার করা উচিত নয় : মাহফুজ আলম ইসলামি চার রাজনৈতিক দলের লিয়াঁজো কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত ‘স্বৈরতন্ত্র ও স্বৈরতান্ত্রিক বন্দোবস্তের স্থায়ী বিলোপের জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে’ মোবাইলে লাউডস্পিকারে কথা বলা; ইসলাম কি বলে: শায়খ আহমদুল্লাহ জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনতার বিস্ফোরণ: রাষ্ট্রপতি মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে ড. শোয়াইব আহমদের সৌজন্য সাক্ষাৎ ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করবেন প্রধান উপদেষ্টা সব ধরনের দূষণ রোধে আলেম-ওলামার সহযোগিতা চায় সরকার

হজের সৌন্দর্য ও রহস্যকথা


নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ছবি: সংগৃহীত

মুহাম্মাদ আশরাফুল আলম

কোনো বিধানের প্রকৃত সৌন্দর্য তা শরিয়তের পক্ষ থেকে নির্দেশিত হওয়ার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। কেননা আল্লাহ তায়ালা মহান হেকমতওয়ালা। আর মহা প্রজ্ঞাময় এমন কোনো হুকুম দিতে পারেন না যাতে সামান্যতম অনিষ্টতা রয়েছে। শরিয়তের প্রতিটি বিধানের মধ্যেই অনেক হেকমত ও সৌন্দর্য বিদ্যমান রয়েছে। তবে সকল সৌন্দর্য মানুষ অনুধাবন করতে সক্ষম নয়। কিছু সৌন্দর্য এমন স্পষ্ট ও প্রকাশ্য হয়ে থাকে যে, তা সাধারণ মানুষও অনুধাবন করতে পারে। আমরা নিম্নোক্ত আলোচনায় ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান হজের হাতেগোনা কয়েকটি সৌন্দর্য তুলে ধরব।

১. ‘হজ’-এর শাব্দিক অর্থ হলো, কোনো কিছুর দৃঢ় ইচ্ছা করা। দৃঢ় ইচ্ছার সম্পর্ক অন্তরের সাথে। পূর্ণ শরীরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ অঙ্গ দিল বা অন্তর। ‘হজ’কে হজ বলে নামকরণের মধ্যে পরোক্ষ ইঙ্গিত রয়েছে যে, হজ একটি উঁচু স্তরের ইবাদত। এ কারণে হজকে ‘হজ’ (ইচ্ছা ও প্রতিজ্ঞা) নাম দেওয়া হয়েছে। যার সম্পর্ক মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের সাথে। আর এটা জানা কথা যে, দৃঢ় ইচ্ছা বা প্রতিজ্ঞা মানুষকে অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। সুতরাং হজও মানুষকে তার চূড়ান্ত লক্ষ্য—আল্লাহর সন্তুষ্টির দ্বার পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।

২. হজের আমলসমূহের সাধারণ বাহ্যিক দৃশ্যাবলী হাশরের ময়দানের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। মানুষ কবর থেকে উঠে হাশরের ময়দানে এমনভাবে একত্রিত হবে যে, কারও শরীরে কোনো কাপড় থাকবে না, খোলা মাথা ও খালি পায়ে থাকবে। চরম অস্থিরতা ও পেরেশানিতে থাকবে। এমনই কিছু অবস্থা হাজী সাহেবদের হয়ে থাকে। কেননা তাদের মাথায়ও টুপি থাকে না, শরীরে জামা থাকে না, না কোনো সুগন্ধি থাকে না, না কোনো সৌন্দর্য থাকে। এর কিছুই থাকে না। বরং পাগলবেশে অস্থির আর পেরেশান অবস্থায় ধীরে ধীরে আরাফার ময়দানে একত্রিত হতে থাকে।

৩. হজের জন্য নিঃসন্দেহে সফর করতে হয়। এজন্য যখন হাজী সাহেব সফরের সামানা নিয়ে প্রস্তুত হয়ে বের হন, তখন এটাই বোঝা যায় যে, সে পরিবার-পরিজন ও ভালোবাসার মানুষগুলো থেকে বিচ্ছেদের বেশ ধরেছে। আর একদিন তো দুনিয়া থেকে বিদায় নিতেই হবে। সুতরাং হজের সফরের কারণে বিচ্ছেদ-বেদনার সাথে এক প্রকারের সখ্যতা তৈরি হয়। এতে করে মৃত্যুর মাধ্যমে বিচ্ছেদের বিষয়টি হাজী সাহেবের জন্য সহজ ও বরদাশতযোগ্য হয়ে যায়। অন্যথায় আখেরাতের সফরের স্থায়ী বিচ্ছেদ-বেদনা উভয়ের জন্য ভয়, শংকা, পেরেশানি, অধৈর্য আর অস্থিরতার দৃশ্য নিয়মিত চোখে পড়ে।

৪. হাজী সাহেব যখন হজের সফরের ইচ্ছা পোষণ করেন, তখন তিনি সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে থাকেন। এমনকি অভিজ্ঞ লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করে প্রতিটি জিনিস খুব গুরুত্বের সাথে নিয়ে থাকেন। অথচ এটা এমন সফর—যদি কোনো জিনিস কমও হয়ে যায় তথাপি সে ওখান থেকে পূরণ করতে পারবে। বরং সব জিনিসই সেখানে পাওয়া যায়। উপরন্তু এ সফর থেকে সে ফিরেও আসবে। সফরের আসবাব জমা করতে গিয়ে তার এই অনুভূতি অবশ্যই জাগ্রত হবে যে, এ সামান্য কিছু দিনের সফরের জন্য যদি এত মেহনত আর পরিশ্রম করতে হয়, তাহলে আখেরাতের সফরের জন্য এর চেয়ে কত গুণ বেশি প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে! কেননা সেখানে তো কেবল এমন জিনিসই কাজে লাগবে যা মানুষ দুনিয়া থেকে নিয়ে যাবে। তাছাড়া সেখান থেকে আর ফিরেও আসা যাবে না।

৫. যখন হাজী সাহেব সফরের জন্য বের হন তখন এ দৃশ্য দেখা যায় যে, যারা বেশি প্রয়োজনীয় সামানা নিয়ে গিয়েছে তারা বেশি আরাম করছে। হজের দৃশ্য এবং পরিস্থিতি অনেকটাই আখেরাতের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, তাই হাজী সাহেবের এই শিক্ষা হাসিল হয় যে, কাল হাশরের ময়দানেও সেই ব্যক্তি সবচেয়ে আনন্দে থাকবে, যে ব্যক্তি ঈমানের পর বেশি বেশি নেক আমল করে গিয়েছে। এ হিসেবে সেও (হাজী সাহেবও) নেক আমলের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে।

৬. এটা অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রমাণিত যে, হজের বরকতে লোকটি বড় ধরণের কৃপণতার মতো আত্মিক ব্যাধি থেকে মুক্তি পেয়ে যায়। কেননা হজের সফরে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় নিজের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার প্রতি খেয়াল রাখার জন্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সম্পদ ব্যয় করতেই হয়। এতে করে সম্পদ খরচ না করার ব্যাধি দূর হয়ে যায়।

৭. হজের বরকতপূর্ণ সফরের মাধ্যমে মুসলমান ‘তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ’—পূর্ণ ভরসা আল্লাহর উপর—এর গুণে গুণান্বিত হয়। কেননা এ সফরে সে প্রয়োজনীয় আসবাব নেওয়ার ব্যাপারে সর্বাত্মক চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু সবকিছুই তো নেওয়া সম্ভব নয়। তাই অতি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নেয় আর অন্যগুলোকে রেখে যায়। আর বলে, ‘আল্লাহ যেন নিরাপত্তা দান করেন।’ আর এটাই তো ‘তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ’—আল্লাহর উপর ভরসা—এর বাস্তব রূপ। মুফতি শফী রহ. বলতেন, তাওয়াক্কুল হচ্ছে—নিজের সাধ্যমতো বাহ্যিক সামানা প্রস্তুত করে ফলাফল আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেওয়া। বাহ্যিক জিনিসপত্র নিয়ে গর্ব না করা এবং অহংকার না দেখানো। বরং পরিপূর্ণ ভরসা আল্লাহর উপর করা।

৮. হজের একটি সৌন্দর্য হলো, এ সফরের কারণে তার আমলের মূল্য বৃদ্ধি পায়। যেমন মক্কার হারাম শরীফে এক নামাযের ছওয়াব এক লাখ এবং মসজিদে নববীতে এক হাজার নামাযের ছওয়াব লাভ হয়।
এমনিভাবে হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি পায়ে হেঁটে হজে যাওয়া-আসা করে তার প্রতি কদমের বিনিময়ে সাতশত পর্যন্ত নেকি লেখা হয়।
হযরত হাসান বসরি রহ. বলেন, হারাম শরীফে এক রোযা এক লাখ রোযার বরাবর, এক দিরহাম সদকা করা এক লাখ দিরহাম সদকা করার নামান্তর।

৯. হজের সফরে হাজী সাহেব অনেক কষ্ট সহ্য করেন। সফরের পর সফর আর নির্ঘুম রাত যাপনের কারণে পুরো শরীর যেন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু যখন হারাম শরীফে পৌঁছে বায়তুল্লাহর যিয়ারতের দ্বারা চক্ষু শীতল করে তখন সফরের সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। একটু চিন্তা করে দেখুন, বায়তুল্লাহ দেখার অবস্থাই যদি এই হয় তাহলে বায়তুল্লাহর মালিকের দীদারে অবস্থা কেমন হবে! সুবহানাল্লাহ!

১০. মৃত্যুর পর সেলাইকৃত কাপড় খুলে কাফনের কাপড় পরানো হয়। ঠিক এভাবে হাজী সাহেব এহরাম বাঁধেন, তখন শরীরের সেলাই করা পোশাক খুলে কাফনের মতো দুটি কাপড় পরিধান করেন। এর মধ্যে এই ইঙ্গিত রয়েছে যে, হাজী সাহেব যখন ইহরাম বাঁধেন তখন কেমন যেন তিনি মারা যান। আর হজ থেকে ফিরে আসার পর যেন তার আখেরাতের সেই বাসনা পূরণ হয়—

﴿يَا لَيْتَنَا نُرَدُّ وَلَا نُكَذِّبَ بِآيَاتِ رَبِّنَا وَنَكُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ﴾
"হায়! আমাদেরকে যদি দুনিয়ায় ফেরত পাঠানো হতো...।" (সূরা আন‘আম: ২৭)

তাকে যেন আখেরাতের প্রস্তুতির আরেকটি সুযোগ দেওয়া হলো।

১১. নামায শেষে যেমন সালাম ফিরিয়ে নামায শেষ হয়, ঠিক তেমনি ইহরামকারী মাথা মুণ্ডানো বা চুল ছোট করার মাধ্যমে ইহরাম মুক্ত হয়। তখন সব কিছু জায়েয হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা যেন বলেন, ‘তুমি আমার হুকুম মোতাবেক রুচির পরিপন্থী জিনিস দূর করলে, আমি আমার পক্ষ থেকে তোমার অভ্যন্তরীণ অপছন্দনীয় পঙ্কিলতা দূর করে দিচ্ছি।’

১২. হজের সৌন্দর্যের একটি দিক হলো ‘তাওয়াফে সদর’ বা বিদায়ী তাওয়াফ। হাজী সাহেব আল্লাহর মেহমান হয়ে সেখানে অবস্থান করে যখন বিদায়ের সময় আসে, তখন মেযবান আল্লাহর নিকট অনুমতি চেয়ে বিদায় নেয়। এভাবেই মহান আল্লাহ তায়ালা ফেরার সময় হাজীকে মহামূল্যবান হাদিয়া-তোহফা দেন—সাধারণ স্তরে ক্ষমা এবং সবচেয়ে বড় নেয়ামত: আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মাগফিরাত।

(মাসিক বাইয়্যিনাত – বিন-নূরী টাউন করাচী এর মুখপত্র থেকে অনুবাদ)

এসএকে/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ