সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫ ।। ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২ ।। ৩ সফর ১৪৪৭


দ্রুজ সংঘাত: সিরিয়ায় ইসরায়েলের নতুন ষড়যন্ত্র

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা ওয়ালিউল্লাহ আজিজী 

মধ্যপ্রাচ্য এক আগুনের গোলা। কখনো শিয়া-সুন্নি বিভাজন, কখনো কুর্দিদের স্বাধীনতার দাবি, কখনো ইসরায়েল-ফিলিস্তিন অস্থিরতা—সংকট যেন এখানকার দৈনন্দিন রুটিন। এই উত্তপ্ত অঞ্চলে প্রতিটি অস্থিরতার পিছনে কোন শক্তিশালী রাষ্ট্র কিংবা সম্প্রদায়ের কালো হাত থাকে। মধ্যপ্রাচ্যকে  আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের বৈধ ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করে , যার নৈতিক এবং আইনগত কোন ভিত্তি নেই।। আজ সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ সুইদা ঘিরে যে সংঘাতের আগুন জ্বলছে, তার কেন্দ্রে আছে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়—দ্রুজ। আর সেই আগুনে ঘি ঢালছে ইসরায়েল। এই দ্রুজ সম্প্রদায়কে ব্যবহার করে ইসরাইল সিরিয়াকে স্থায়ীভাবে অশান্ত রাখার ষড়যন্ত্র করছে।

দ্রুজ সম্প্রদায়ের পরিচয় 
দ্রুজরা সংখ্যায় কম হলেও সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী। তারা মূলত সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, ইসরায়েল ও গোলান মালভূমিতে বসবাস করে। মুখে লম্বা দাড়ি ও গায়ে পাঞ্জাবি-টুপি দেখে যে কেউ তাদের মুসলিম ভাবতে পারেন! উপরন্ত নারীদের হিজাব ও বোরকার মতো বেশভূষা থাকলেও তারা আদতে মুসলিম নয়। যদিও তারা সবাই আরবি ভাষায় কথা বলে। দ্রুজ ধর্মটি শিয়া ধর্মের একটি শাখা থেকে উৎপত্তি হলেও এটি পরবর্তীতে একটি স্বতন্ত্র ধর্মীয় মতবাদে (দ্রুজ ধর্মে) রূপান্তরিত হয়। তাদের এই স্বতন্ত্র ধর্ম গ্রীক দর্শন দ্বারাও প্রভাবিত। তাদের ধর্মগ্রন্থ—রাসাইল আল-হিকাম। এই সম্প্রদায় নিজস্ব বিশ্বাস ও সংস্কৃতিতে  মুসলিম সমাজ থেকে আলাদা।

তবে ধর্ম নয়, এখন তাদের রাজনৈতিক ভূমিকাই বেশি আলোচিত হয়ে উঠছে।

সুইদায় উত্তেজনার সূত্রপাত
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সিরিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন মোড় আসে। দীর্ঘ ১৫ বছরের গৃহযুদ্ধ শেষে পতন ঘটে বাশার আল-আসাদ সরকারের। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন বিপ্লবী সরকার ক্ষমতায় আসে আহমেদ আশ-শারার নেতৃত্বে। স্বাভাবিকভাবেই সরকার দেশজুড়ে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। কিন্তু সুইদা প্রদেশ, যেখানে দ্রুজরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে এই প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়।

দ্রুজরা সিরিয়ার সাম্প্রতিক ইতিহাসে বরাবরই আসাদ ঘনিষ্ঠ ছিল। তারা নিজস্ব মিলিশিয়া গড়ে তুলেছিল, গড়ে তুলেছিল একটি অঘোষিত স্বায়ত্তশাসন। সরকার যখন সেখানে সেনা মোতায়েন বাড়ায়, দ্রুজরা তা প্রতিরোধ করে। সংঘর্ষে প্রায় ৬০০ দ্রুজ নিহত হয়। নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় তারা মাতৃভূমির সাথে গাদ্দারি করতেও দ্বিধা করে না। নিজ দেশের বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে তারা ইসরাইলের কাছে সহায়তা চায়। সরকার বিরোধী বিক্ষোভ-মিছিলে তাদের হাতে দেখা যায় ইসরায়েলের পতাকা, তাদের ব্যানারে লেখা: We Want Israel।

১৫ জুলাই থেকে ইসরায়েল সিরিয়ার ভেতরে বিমান হামলা শুরু করে। তাদের দাবি—দ্রুজ সংখ্যালঘুদের রক্ষা করা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ইসরায়েলের উদ্দেশ্য কি সত্যিই এক মুসলিম-সদৃশ সম্প্রদায়ের 'রক্ষা'? যদি তাই হয় তাহলে এই দায়িত্ব ইসরাইলকে কে দিয়েছে? নাকি এটি একটি সুপরিকল্পিত কৌশল, যাতে সিরিয়া আবারও গৃহযুদ্ধে জর্জরিত হয়?

ইসরায়েলের লক্ষ্য দুইটি:
১. সিরিয়ার নতুন বিপ্লবী সরকার যেন শক্তিশালী হতে না পারে। ইসরায়েল খুব ভালো করেই জানে—যদি এই নতুন সরকার সিরিয়া জুড়ে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তবে  তা ইসরাইলের জন্য বুমেরাং হতে পারে। বিশেষত তারা যদি ইসলামী মূল্যবোধ বা আরব জাতীয়তাবাদকে প্রাধান্য দেয়, তবে সেটা ইসরায়েলের জন্য ভবিষ্যত-হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই শুরুতেই সেই সম্ভাবনাকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়াই ইসরায়েলের কৌশল।

২. গোলান মালভূমির পাশে নিরাপত্তাহীন এলাকা গড়ে তোলা।সুইদা প্রদেশ গোলান মালভূমির ঠিক সন্নিকটে। এই এলাকা যদি সিরিয়ান আর্মির হাতে থাকে, তবে ইসরায়েলের উত্তরের সীমান্তে চাপ বাড়ে। তাই ইসরায়েল চায় এখানে একটি অসামরিক বা নিরাপত্তাহীন অঞ্চল তৈরি করতে, যেখানে কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দখল না থাকে, বরং ছোট ছোট গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘাত লেগেই থাকে।

দ্রুজরা কি প্রক্সি বাহিনীতে রূপ নিচ্ছে?
সরকার চাইছে দ্রুজ মিলিশিয়াদের সিরিয়ান আর্মিতে অন্তর্ভুক্ত করতে। বিপ্লবী সরকার বলছে, আমরা চাই সকল সম্প্রদায় মিলেমিশে থাকুক। সকল সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার দায়িত্ব এই সরকার গ্রহণ করছে। কিন্তু দ্রুজরা  নিজেদের স্বার্থে শঙ্কিত হয়ে  এমন শক্তির সাথে হাত মেলাতে চাইছে, যেখান থেকে তারা অস্ত্র, অর্থ কিংবা আন্তর্জাতিক সমর্থন পায়।

মধ্যপ্রাচ্যের যে কোন মুসলিম রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল রাখার জন্য ইসরাইল সবসময় সহায়তার নামে তার একটি কালো হাত আগে থেকেই বাড়িয়ে রেখেছে।

আজ  দ্রুজরা ইসরায়েলের সাথে হাত মিলিয়েছে। খুব শীঘ্রই দ্রুজরা তেলআবিবের পৃষ্ঠপোষকতায় এক প্রক্সি বাহিনী হয়ে উঠবে—যারা সিরিয়ার স্থিতিশীলতার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।

বিভিন্ন কার্ডে ইসরায়েলি ষড়যন্ত্র 
বিগত এক দশকে ইসরায়েল একের পর এক কার্ড খেলেছে—কখনো কুর্দি, কখনো শিয়া-সুন্নি বিভেদ, আবার কখনো আইএস দমনের ছলে আকাশপথে বোমা বর্ষণ। এবার তাদের নতুন কার্ড হলো দ্রুজ সম্প্রদায়। আর লক্ষ্য, একটাই—সিরিয়া যেন কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।

আরও গভীরে গেলে দেখা যায়, শুধু সিরিয়াই নয়—ইসরায়েল চায় পুরো মধ্যপ্রাচ্যই অস্থির থাকুক, যেন তাদের নিজের নিরাপত্তা আর আধিপত্য অক্ষুণ্ন থাকে।

যে অঞ্চল একদিন ইসলামি ঐক্যের ভিত্তিতে দাঁড়াতে পারে, সেই অঞ্চলেই তারা দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত বাধিয়ে রাখতে চায়। তারা মনে করে,যতক্ষণ এই অঞ্চল অস্থির থাকবে, ততক্ষণ ইসরায়েল  নিরাপদ থাকবে।

মুসলিম উম্মাহকে তারা দেখতে চায়, একটি  বিভক্ত ও দ্বন্দ্বে জর্জরিত দুর্বল জাতি হিসেবে।

আর তার জন্য তারা কখনো দ্রুজদের ব্যবহার করবে, কখনো কুর্দিদের, কখনো শিয়া সুন্নিদের, আবার  কখনো অন্য কাউকে।

সবকিছু স্পষ্ট। তবু আরব নেতাদের বোধোদয় হয় না। ভয়ংকর ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ইসরায়েলের কথায় তারা নিজেদের মাঝেই বিভেদ বাধিয়ে বসে! প্রতিটি রক্তপাতে বিজয়ের হাসি হাসে ইসরায়েল।

এটাই ইসরায়েলের কৌশল—ঘরভাঙা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে নিজেই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা।

লেখক: ফাজেল, জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া 
উচ্চতর ফিকহ, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা 
অনার্স, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ

এমএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ