রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫ ।। ১২ শ্রাবণ ১৪৩২ ।। ২ সফর ১৪৪৭

শিরোনাম :
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সারাদেশের সব কমিটির কার্যক্রম স্থগিত দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি বিএনপির এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ ১০ বছরের পক্ষে ঐকমত্য : আলী রীয়াজ মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে মৃত্যুবরণকারীরা শহীদের মর্যাদাপ্রাপ্ত সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা’ স্থাপনের ব্যাপারে বিএনপির প্রস্তাবে একমত এবি পার্টি তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠানে ইতমিনান পাবলিকেশন্সের বই ৭ দফা দাবিতে ঢাকা আলিয়ার শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন সাঁজোয়া যানে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দুই ইসরায়েলি সেনাকে হত্যা একটা নতুন সংবিধানের দাবিতে রাজপথে নেমেছি: নাহিদ ইসলাম রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: মুসলিম উম্মাহর অবস্থান স্পষ্ট থাকতে হবে 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: মুসলিম উম্মাহর অবস্থান স্পষ্ট থাকতে হবে 

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ছবি: সংগৃহীত

মাওলানা ওয়ালিউল্লাহ আজিজী 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তৃতীয় বর্ষে গড়ালেও এর নিষ্পত্তির কোনো সম্ভাব্য পথ এখনো দৃশ্যমান নয়। বরং যুদ্ধের বিস্তার, সামরিক জোটগুলোর ভূমিকা এবং কূটনৈতিক চাপ এ সংঘাতকে দিন দিন আরও জটিল ও বহুমাত্রিক করে তুলছে। যুদ্ধের পরিধি শুধু রণক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা ছড়িয়ে পড়েছে অর্থনীতি, রাজনীতি, নিরাপত্তা কাঠামো ও মানবাধিকার ইস্যুতেও। এমনকি এই যুদ্ধ মুসলিম বিশ্বকেও প্রভাবিত করছে। 

ইউক্রেন যুদ্ধকে যদি কেবল একটি দ্বিপাক্ষিক সংঘাত হিসেবে দেখি, তবে আমরা ভুল ক্যানভাসে তুলির আঁচড় কাটছি। এই যুদ্ধ, আসলে একটি দীর্ঘস্থায়ী ভূরাজনৈতিক খেলায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে—যেখানে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বলয় শুধু অস্ত্র নয়, তথ্য, অর্থনীতি, কূটনীতি এবং পরমাণু হুমকিকে একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে এই যুদ্ধে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রাশিয়া কিংবা আমেরিকা–কোন এক পক্ষের ক্রীড়নকে পরিণত হলেই তাদের জন্য রয়েছে অশনি সংকেত। তাই মুসলিম বিশ্বের সামনে আত্মমর্যাদার সাথে নিজেদের স্বার্থের পক্ষে পদক্ষেপ নেয়া ছাড়া বিকল্প নেই।

রাশিয়ার লক্ষ্য: পশ্চিমা বলয় ভাঙা
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দৃষ্টিতে ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়ার জন্য একটি অস্তিত্বগত লড়াই। এটি কেবল সীমান্ত সুরক্ষা নয়, বরং পশ্চিমা দুনিয়ার ‘Unipolar Order’ এর বিরুদ্ধে রাশিয়ার ঘোষিত চ্যালেঞ্জ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর অগ্রগতি এবং ইউক্রেনকে পশ্চিমা প্রভাবমণ্ডলে টেনে আনার প্রচেষ্টা রাশিয়ার জন্য ছিল একধরনের 'রেড লাইন'। সেই লাইন অতিক্রম করলেই যুদ্ধ অনিবার্য—এমনটাই ছিল পুতিন প্রশাসনের বার্তা।

যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য: বিশ্ব নেতৃত্ব পুনঃনিশ্চিতকরণ
ইউক্রেন যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি 'স্ট্র্যাটেজিক গোল্ডমাইন' হয়ে উঠেছে—বিশ্ব নেতৃত্ব পুনরুদ্ধারের এই সুযোগ তারা সহজে হাতছাড়া করতে চায় না। এই যুদ্ধের মাধ্যমে আমেরিকা ইউরোপকে আবার আমেরিকার উপর নির্ভরশীল করতে চায়। অস্ত্র, গ্যাস, কূটনীতি—সবকিছুতেই মার্কিন নেতৃত্ব এখন কেন্দ্রীয়।

ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট তার সামরিক শিল্পে বিপুল বিনিয়োগ ও রপ্তানির সুযোগ তৈরি করতে চায়। অন্য রাষ্ট্রের উপর শক্তিপ্রয়োগ ও নিষেধাজ্ঞার রাজনীতি্য বৈধতা তৈরি করতে চায়।

মুসলিম বিশ্বের অবস্থান 
১.ভূ-রাজনৈতিক খেলায় মুসলিম রাষ্ট্রগুলো এখন ‘ব্যালান্সার’। তুরস্ক, সৌদি আরব, কাতার, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত—এই মুসলিম প্রধান দেশগুলো এখন পশ্চিমা ও রাশিয়ান বলয়ের মাঝে ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। ইস্তাম্বুলে যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের চুক্তি, সৌদি আরবের শান্তি উদ্যোগ এবং কাতারের কূটনৈতিক ভূমিকা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হচ্ছে।

২. উম্মাহর আর্থিক শক্তি কৌশলগতভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ইউরোপ ও আমেরিকা এখন আবারও মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। পেট্রোডলার ও ইসলামী অর্থনীতির ভিত্তি এখন পশ্চিমা বলয়ের চোখে আরও গুরুত্বপূর্ণ।তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো এই সুযোগকে বিশ্ব নেতৃত্ব পুনঃগঠনে প্রভাবশালীভাবে ব্যবহার করতে পারছে না।

৩. উইপনাইজড মিডিয়া ও ইসলামফোবিয়া: এক প্রচ্ছন্ন ফ্রন্টলাইন
ইউক্রেন যুদ্ধের নেপথ্যে পশ্চিমা মিডিয়ার ইসলামফোবিক ধারা আরও স্পষ্ট হয়েছে। যখন ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের মানবিক সহানুভূতিতে গ্রহণ করা হচ্ছে, ঠিক একই সময়ে ফিলিস্তিনি, সিরীয় বা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি চরম পক্ষপাতমূলক আচরণ করা হচ্ছে। এ যেন ‘শ্বেতাঙ্গ শরণার্থী’ বনাম ‘মুসলিম শরণার্থী’র প্রতি দ্বিমুখী মানবিকতা। আমেরিকার এই দ্বিচারিতার কারণে মুসলিম বিশ্বে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে।

৪. ফিলিস্তিন ও ইউক্রেন: দুটি যুদ্ধ, দুটি মানদণ্ড
একদিকে ইউক্রেনের ভূখণ্ড রক্ষার লড়াইয়ে বিশ্বজুড়ে অস্ত্র, সমর্থন ও মিডিয়ার হৈচৈ; আরেকদিকে ফিলিস্তিনের মুক্তির লড়াইকে সন্ত্রাসবাদ আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। একটি শান্তিময় ভূখণ্ডের পঞ্চাশ হাজারের অধিক নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। তবু এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়নি! আমেরিকার এই দ্বিচারিতার তুলনা মেলা ভার।

মুসলিম বিশ্ব এই দ্বৈত নীতির বিরুদ্ধে সম্মিলিত নৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না—এটা এই যুদ্ধের বড় গোপন ট্র্যাজেডি।

মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব 
এই যুদ্ধ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শক্তির রাজনীতি সর্বদা ন্যায়বিচার করে না। তাই মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব কেবল নিজস্ব ভূখণ্ড রক্ষা নয়; বরং বিশ্ব শান্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে একটি ইসলামিক শক্তিশালী কণ্ঠস্বর গড়ে তোলা। সাংবাদিকতা ও বিশ্লেষণে পক্ষপাতহীন ভাবে সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো, যেন মুসলিম বিশ্ব নিজের বয়ান তুলে ধরতে পারে। কূটনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ ও মানবিক ভূমিকা রাখা, যেমনটা তুরস্ক করছে। এতে করে বিশ্ববাসীর সামনে মুসলিম দেশগুলোর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি ইসলামী অর্থনীতিকে আত্মনির্ভর করে গড়ে তোলা, যেন মুসলিম দেশগুলো আর পশ্চিমা বলয়ের ঋণচক্রের শিকার না হয়।উম্মাহ ভিত্তিক কনসেনসাস তৈরি করা, যেখানে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো অন্তত ফিলিস্তিন-সিরিয়া-ইয়েমেনের মতো ইস্যুতে সম্মিলিত অবস্থান নিতে পারে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখন কেবল ইউরোপীয় কনফ্লিক্ট নয়—এটি একটি ‘নিউ-ওয়ার্ল্ড অর্ডার’-এর জন্ম প্রক্রিয়া। প্রশ্ন হলো, মুসলিম বিশ্ব সেই ইতিহাসের দর্শক থাকবে, না অংশগ্রহণকারী হবে?

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে বন্দি বিনিময়ের মধ্য দিয়ে মানবিক বার্তা এলেও, তার ছায়ায় লুকিয়ে আছে পরাশক্তিগুলোর রূপ বদলের নীলনকশা। এই বিশ্লেষণ তাই শুধু ভূরাজনীতি নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর জন্য আত্মসচেতনতার আহ্বান।

লেখক: ফাজেল, জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া 
উচ্চতর ফিকহ, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা 
অনার্স, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ 

এমএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ